জান্নাতিদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ এবং মতভেদ থাকবে না
হিংসা-বিদ্বেষ পার্থিব জীবনের এক মারাত্মক ব্যধি এবং সামাজিক জীবনে অশান্তির এক মহাকরাণ। কিন্তু জান্নাতে এসব থাকবে না। জান্নাতিদের মাঝে পরস্পর ভালোবাসা আর হৃদ্যতা থাকবে। এক দেহ এক মন নিয়ে তারা জান্নাতের নেয়ামত ভোগ করবে। কোন হিংসা-বিদ্বেষ পরশ্রীকাতরতা এসব কিছুই থাকবে না। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, তাদের (জান্নাতিদের) অন্তরগুলো এক ব্যক্তির অন্তরের মতো থাকবে। তাদের মধ্যে কোনো রকম মতভেদ থাকবে না আর পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করবে। তারা রোগাক্রান্ত হবে না, নাক ঝাড়বে না, থুথু ফেলবে না। তাদের পাত্রগুলো হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের আর চিরুনি হবে স্বর্ণের। তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধি কাষ্ঠ। আবুল ইয়ামান (রহ.) বলেন, অর্থাৎ কাষ্ঠ। তাদের গায়ের ঘাম মিসকের মতো সুগন্ধময় হবে। (বোখারি : ৩২৪৬)।
জান্নাতের ফলমূল ও গাছের বর্ণনা
জান্নাতে অনেক ফল-ফুলের বাগান থাকবে। গাছ থাকবে, যেগুলোর ছায়ায় জান্নাতিরা আরাম করবেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এরশাদ করেন, আর যারা ডানদিকে থাকবে,তারা কত ভাগ্যবান, তারা থাকবে কাঁটাবিহীন বদরিকা বৃক্ষে এবং কাঁদি কাঁদি কলায় এবং দীর্ঘ ছায়ায়। প্রবাহিত পানিতে ও প্রচুর ফলমূলে যা শেষ হওয়ার নয় এবং নিষিদ্ধও নয়। (সুরা ওয়াকিয়া : ২৭-৩৩)। জান্নাতে এমন একটি গাছ থাকবে, যার ছায়া অনেক দীর্ঘ। হাদিস শরিফে এসেছে, আনাস ইব্?নু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, জান্নাতে এমন একটি গাছ আছে, যার ছায়ায় কোনো আরোহী শত বছর পর্যন্ত চললেও তা অতিক্রম করতে পারবে না। (বোখারি : ৩২৫১, মুসলিম : ৭০৩০)।
জান্নাতিরা একে অপরকে দেখতে পাবে
জান্নাতিরা পদমর্যদায় ভিন্ন ভিন্ন বালাখানায় থাকলেও তারা একে অপরকে দেখতে পারবে। হজরত আবু সা’ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, অবশ্যই জান্নাতবাসী তাদের উপরের বালাখানার বাসিন্দাদের এমনভাবে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা আকাশের পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে উজ্জ্বল দীপ্তিমান নক্ষত্র দেখতে পাও। এটা হবে তাদের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্যের কারণে। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহ্?র রাসুল (সা.) এ তো নবীদের জায়গা। তাদের ব্যতীত অন্যরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, যেসব লোক আল্লাহ্?র প্রতি ঈমান আনবে এবং রাসুলদের সত্য বলে স্বীকার করবে। (বোখারি : ৩২৫৬, মুসলিম : ৬৮৮১)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, জান্নাতবাসী নিজেদের অট্টালিকা (প্রাসাদ) থেকে সম্মান অনুযায়ী পরস্পরকে দেখতে পাবে, যেভাবে তোমরা পূর্বাকাশে উদয়াচলে ও পশ্চিমাকাশে অস্তাচলে নক্ষত্রগুলো দেখতে পাও। তারা প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহ্?র রাসুল (সা.)! তারা কি নাবীরা? তিনি বলেন, হ্যাঁ। সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন! সেসব ব্যক্তিও উচ্চ সম্মানের আসনে থাকবে যারা আল্লাহ্? ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং রাসুলদেরকে সত্য বলে স্বীকার করেছে। (তিরমিজি : ২৫৫৬)।
জান্নাতে একটি বাজার থাকবে, সেখানে পরস্পর মিলিত হবে
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। একাকী থাকা মানুষের স্বভাবজাত নয়। একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, খোশগল্প এসব আয়োজন জান্নাতেও থাকবে। জান্নাতে একটি বাজার হবে, যেখানে জান্নাতিরা পরস্পর মিলিত হবে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জান্নাতে একটি বাজার থাকবে। প্রত্যেক জুমায় (সপ্তাহে) জান্নাতি লোকেরা এতে সমবেত হবে। অতঃপর উত্তরের বায়ু প্রবাহিত হয়ে সেখানকার ধুলাবালি তাদের মুখমণ্ডল ও কাপড়-চোপড়ে গিয়ে লাগবে। এতে তাদের রূপ ও সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর তারা নিজ পরিবারের কাছে ফিরে আসবে। এসে দেখবে, তাদের গায়ের রং এবং সৌন্দর্য বহু বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর তাদের পরিবারের লোকেরা বলবে, আল্লাহর কসম! আমাদের কাছ থেকে যাওয়ার পর তোমাদের রূপ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরে তারাও বলবে, আল্লাহর শপথ! আমাদের যাওয়ার পর তোমাদের রূপসৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। (মুসলিম, ইফা নং : ৬৮৮৩)।
অন্য বর্ণনায় এসছে, সা’ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহ.) একদা আবু হুরাইরা (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাকে ও তোমাকে জান্নাতের বাজারে একত্র করেন। সা’ঈদ (রহ.) প্রশ্ন করেন, জান্নাতে কি বাজারও আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে জানিয়েছেন যে, জান্নাতিরা জান্নাতে গিয়ে নিজ নিজ আমলের পরিমাণ ও মর্যাদা অনুযায়ী সেখানে জায়গা (মর্যাদা) পাবে। তারপর দুনিয়ার সময় অনুসারে জুমার দিন তাদেরকে (তাদের রবের দর্শনের) অনুমতি দেয়া হবে এবং তারা তাদের রবকে দেখতে আসবে। তাদের জন্য তাঁর আরশ প্রকাশিত হবে। জান্নাতের কোনো এক বাগানে তাদের সামনে তাদের প্রভুর প্রকাশ ঘটবে। অতঃপর আমাদের রব বলবেন ঃ ওঠো! আমি তোমাদের সম্মানে যে মেহমানদারি প্রস্তুত করেছি সেদিকে অগ্রসর হও এবং যা কিছু পছন্দ হয় তা গ্রহণ কর। তখন আমরা একটি বাজারে এসে হাজির হব, যা ফেরেশতারা ঘিরে রাখবে। সেখানে এরূপ পণ্যসামগ্রী থাকবে, যা না কোনো চোখ দেখেছে, না কোনো কান শুনেছে এবং না কখনও অন্তরের কল্পনায় ভেসেছে। আমরা সেখানে যা চাইব, তাই তুলে দেয়া হবে। তবে বেচা-কেনা হবে না। আর সে বাজারেই জান্নাতিরা একে অপরের সঙ্গে দেখা করবে।
উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন জান্নাতি সামনে এগিয়ে তার চাইতে অল্প মর্যাদাবান জান্নাতির সঙ্গে দেখা করবে। তবে সেখানে তাদের মধ্যে উঁচু-নীচু বলতে কিছু থাকবে না। তিনি তার পোশাক দেখে অস্থির হয়ে যাবেন। এ কথা শেষ হতে না হতেই তিনি মনে করতে থাকবেন যে, তার গায়ে আগের চাইতে উত্তম পোশাক দেখা যাচ্ছে। আর এরূপ এজন্যই হবে যে, সেখানে কারও দুঃখণ্ডকষ্ট বা দুশ্চিন্তা স্পর্শ করবে না। তারপর আমরা নিজেদের স্থানে ফিরে আসব এবং নিজ নিজ স্ত্রীদের দেখা পাব। তারা তখন বলবে, মারহাবা, স্বাগতম! কি ব্যাপার! যে রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলে, তার চাইতে উত্তম সৌন্দর্য নিয়ে ফিরে এসেছ। আমরা বলব, আজ আমরা আমাদের আল্লাহ্তায়ালার সঙ্গে মাজলিসে বসেছিলাম। কাজেই এ পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। আর এটাই ছিল স্বাভাবিক। (তিরমিজি : ২৫৪৯)।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জান্নাতে যে বাজার আছে, তাতে নারী-পুরুষের প্রতিকৃতি ছাড়া আর কিছুর ক্রয়-বিক্রয় হবে না। যখন কেউ কোনো প্রতিকৃতির আকক্সক্ষা করবে, সঙ্গে সঙ্গে তা পেয়ে যাবে। (তিরমিজি : ২৫৫০)
জান্নাতে মোতির বিশেষ তাঁবু
আবদুল্লাহ ইব্?নু কায়স আল-আশ’আরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, গুণসম্পন্ন মোতির তাঁবু থাকবে যার উচ্চতা ত্রিশ মাইল। এর প্রতিটি কোণে মোমিনদের জন্য এমন স্ত্রী থাকবে, যাদেরকে অন্যরা কখনও দেখেনি।’ আবু আবদুস সামাদ ও হারিস ইব্?নু উবায়দ আবু ইমরান (রহ.) হতে ষাট মাইল বলে বর্ণনা করেছেন। (বোখারি : ৩২৪৩)।
জান্নাতিদের শারীরিক অবয়ব কেমন হবে?
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রথমে যে দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো দীপ্তিমান হবে। তাদের পর যারা (জান্নাতে প্রবেশ করবে) তাদের চেহারা আকাশের অতিশয় উজ্জ্বল তারকারাজির মতো হবে। তারা পেশাব-পায়খানা করবে না, থুথু ফেলবে না এবং নাক ঝাড়বে না। তাদের চিরুনি হবে স্বর্ণের। তাদের শরীরের ঘাম থেকে মিশকের ঘ্রাণ আসবে এবং তাদের ধুপদানি হবে সুগন্ধ আগর কাঠের তৈরি। তাদের স্ত্রীরা হবে আয়তলোচনা হুর। তাদের চরিত্র হবে একই ব্যক্তির চরিত্রের মতো। আদি পিতা আদম (আ.) এর আকৃতি হবে তাদের আকৃতি। ষাট হাত লম্বা হবে তাদের দেহ। (মুসলিম, ইফা নং : ৬৮৮৬)।
লেখক : মুহাদ্দিস-জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া, শেখেরচর, নরসিংদী