ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছিল সামুদ জাতি
মুহাম্মদ জিয়াউল হক
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহ সর্বযুগে বান্দার হেদায়াতের জন্য নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। তেমনি সামুদ একটি জাতির নাম। তাদের হেদায়াতের জন্য সালেহ (আ.)-কে নবীরূপে প্রেরণ করেন। সালেহ (আ.) বংশ ও জন্মগতভাবে সামুদ জাতির অন্তুর্ভুক্ত ছিলেন। সালেহ (আ.) তার জাতিকে এই মর্মে দাওয়াত দিয়েছেন ‘তোমরা আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নাও এবং এ কথার বিশ্বাস কর, তিনি ছাড়া উপাস্য হওয়ার উপযুক্ত কেউ নয়।’ কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবুদ (উপাস্য) নেই। তিনিই তোমাদেরকে জমিন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং জমিনে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন। সুতরাং তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এরপর তাওবা কর। নিঃসন্দেহে আমার প্রতিপালক নিকটবর্তী ও কবুলকারী।’ (সুরা হুদ : ৬১)। ভূমিকম্পের আজাব তার সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে আসার আগে এই বলে সতর্ক করেছেন, ‘আজাবের আলামতও শুনে নাও। আগামীকাল বৃহস্পতিবার তোমাদের সবার চেহারা পীতবর্ণের হয়ে যাবে। পুরুষ-মহিলা, শিশু-বৃৃদ্ধ কেউই এর থেকে রেহাই পাবে না। এরপর শুক্রবার সবার চেহারা পুরোপুরি লাল হয়ে যাবে। পরদিন শনিবার সবার চেহারা একেবারে কালো হয়ে যাবে। আর সেদিনই হবে তোমাদের জীবনের শেষ দিন।’ হতভাগা জাতি এ কথা শুনে তাওবা-ইস্তেগফারের পরিবর্তে তাদের নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো।
বৃহস্পতিবার সকালে সালেহ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সামুদ গোত্রের সবার চেহারা এতটাই হলুদ হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল যেন তাদের চেহারায় গভীর হলুদ রং ঢেলে দেয়া হয়েছে। আজাবের প্রথম নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার পরও তাদের চোখ খুলল না, তারা আল্লাহর একত্ববাদের ওপর ঈমান আনল না। নিজেদের ভ্রান্ত কাজকর্ম থেকে ফিরেও আসেনি। সালেহ (আ.)-এর ওপর তাদের রাগ ও ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল এবং পুরো সম্প্রদায় তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। মূলত অহঙ্কারী ও অবাধ্যদের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। এর ফলে তারা লাভকে ক্ষতি, ক্ষতিকে লাভ আর ভালোকে মন্দ, মন্দকে ভালো মনে করতে থাকে। পরদিন নবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সবার চেহারা লাল হয়ে গেল। তৃতীয় দিন ভীষণ কালো হয়ে গেল। এরপর তারা জীবন থেকে হতাশ হয়ে আজাবের অপেক্ষা করতে লাগল, কখন কীভাবে আসে! এ অবস্থায় জমিনে মারাত্মক এক ভূমিকম্প সৃষ্টি হলো এবং আকাশে ভয়ঙ্কর গর্জনধ্বনি শুরু হলো। তখন সামুদ জাতি আসমানি গজব স্বচক্ষে দেখে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ে। তখন তাদের করার মতো কিছুই ছিল না। গোত্রের সবাই বসা অবস্থায়ই উপুড় হয়ে করুণ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। মানব অস্তিত্বের কোনো নিদর্শনই অবশিষ্ট থাকল না।
কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এই শিক্ষণীয় আজাবের বিবরণ এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদেরকে ভূমিকম্প পাকড়াও করল। ফলে সকালবেলা তারা নিজেদের ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আরফ : ৭৮)। ‘আর ভয়ঙ্কর গর্জন পাপিষ্ঠদেরকে পাকড়াও করল। ফলে ভোরবেলা তারা তাদের ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। যেন তারা কোনো দিন সেখানে বসবাস করেনি।’ (সুরা আরফ : ৬৭-৬৮)। এই দুটি আয়াত দ্বারা বোঝা যায় তাদের ওপর দুটি আজাব এসেছিল- ভূমিকম্প ও বিকট গর্জনধ্বনি। ‘সুতরাং সকালবেলা ভয়ঙ্কর এক গর্জন তাদেরকে আঘাত করল। তখন তাদের শিল্প-নৈপুণ্য (পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ) তাদের কোনো উপকারে এলো না।’ (সুরা হিজর : ৮৩)। ‘তারা উটনীটিকে হত্যা করল। ফলে তারা অনুতপ্ত হয়ে গেল। এর পর তাদেরকে পাকড়াও করল আজাব। নিশ্চয় এ ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে।’ (সুরা শুআরা : ১৫৭-১৫৮)। ‘সুতারং দেখ তাদের চক্রান্তের পরিণাম। নিশ্চয় আমি তাদেরকে এবং তাদের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছি। এই তো তাদের বাড়িঘর তাদের অন্যায়ের কারণে জনশূন্য পড়ে আছে। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। আর যারা ঈমান এনেছিল এবং পরহেজগার ছিল, আমি তাদেরকে রক্ষা করেছি।’ (সুরা নামল : ৫১-৫৩)। ‘এরপর তাদের কৃতকর্মের কারণে অবমাননাকর আজাব তথা বিকট গর্জন তাদেরকে পাকড়াও করল। আর যারা ঈমান এনেছিল এবং খোদাভীরু ছিল, তাদেরকে আমি রক্ষা করলাম।’ (সুরা হা-মিম সাজদা : ১৭-১৮)।
‘তাদের ওপর বজ্রাঘাত হলো এমতাবস্থায় যে, তারা তা দেখেছিল। এরপর তারা দাঁড়াতেও সক্ষম হলো না এবং এর কোনো বদলাও নিতে পারল না।’ (সুরা যারিয়াত : ৪৪-৪৫)। ‘আমি তাদের প্রতি একটিমাত্র বিকট গর্জন প্রেরণ করেছি। এতেই তারা হয়ে গেল শুষ্ক শাখাবিশিষ্ট দলিত ভুসির মতো।’ (সুরা কমার : ১৩)। ‘আদ ও সামুদ মহাপ্রলয় তথা কেয়ামতকে মিথ্যা বলেছি। এরপর জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল ভয়ঙ্কর গর্জন দ্বারা আর আদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা।’ (সুরা হাক্কাহ : ৪-৬)। ‘তাদের পাপের কারণে তাদের পালনকর্তা তাদেরকে ধ্বংস করে সবাইকে বরাবর করে দিলেন।’ (অর্থাৎ নারী-পুরুষ, বাচ্চা-বুড়ো কাউকেই জীবিত ছাড়লেন না)। (সুরা শামস : ১৪)।
আল্লাহ সামুদ জাতিকে অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছিলেন। তারা পাহাড় কেটে আলিশান প্রাসাদ নির্মাণ করত। তাদের পানির ঝরনা, ক্ষেত-খামার ও বাগ-বাগিচা ছিল। আজ সেখানকার পুরো উপত্যকায় কোনো বাগান চোখে পড়ে না; কোনো শস্যক্ষেত বা ঝরনাও দেখা যায় না। ঘরবাড়ির কোনো আলামত নেই কোথাও। শুধু পড়ে আছে বিরান মরুভূমি। যার মধ্যে ও আশেপাশে কিছুদূর পরপর পাহাড় কেটে বানানো কিছু ঘর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা তাদের নির্মাণশৈলী ও বসবসকারীদের দুর্ভাগ্যের কথা নীরবে জানান দিয়ে যাচ্ছে। এ জনপদের বর্তমান অবস্থা বর্ণনার জন্য কোরআনে কারিমের এই আয়াতটিই যথেষ্ট- ‘এই তো তাদের বাড়িঘর তাদের অন্যায়ের কারণে বিরান পড়ে আছে। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নামল : ৫২)। এখনও বহু মানুষ তাদের নিদর্শনগুলো দেখতে আসে। কোরআনে বর্ণিত সামুদ জাতির ঘটনা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষার উপকরণ রয়েছে।
লেখক : খতিব, মদিনা জামে মসজিদ, রায়পুরা, নরসিংদী