শুদ্ধ বাংলা চর্চা হোক ভাষার মাসের প্রতিজ্ঞা
মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ভাষা মহান স্রষ্টার অপার এক দান। মানবজাতিকে তিনি এ ভাষার মাধ্যমেই মহিমান্বিত করেছেন। অন্য কোনো প্রাণীকে এই বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয়নি। আমরা যে ধ্বনির মাধ্যমে পরস্পরে আলাপচারিতা করে থাকি, সেটাই হলো ভাষা। ভাষা মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিকে প্রকাশ করে। প্রতিটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। এটা ওই ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে হয়ে থাকে। আরবি ভাষার মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। কারণ এ ভাষায় মহিমান্বিত ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আরবের ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের ভাষা ছিল আরবি। জান্নাতিদের ভাষাও হবে আরবি। আমাদের আদিপিতা আদম ও হাওয়া (আ.) জান্নাতে এ আরবি ভাষায়ই কথা বলেছেন। তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় আরবি ভাষার মান সর্বাগ্রে। এ মর্যাদাকে সবাই অকপটে স্বীকার করে নেন। আর ইংরেজি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাষা। আন্তর্জাতিক মহলে সবাই এ ভাষার মাধ্যমে নিজেদের মাঝে পারস্পারিক কথাবার্তা আদান প্রদান করে থাকেন। তাই যুগ বিবেচনায় ইংরেজি ভাষারও একটা বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। যেটাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা যে ভাষায় কথা বলে থাকি সেটা বাংলা ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা। এর মাধ্যমেই আমরা আন্তঃদেশীয় পারস্পরিক কথা বলে থাকি। যেহেতু আমি এ ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছি তাই আমার মাতৃভাষার সঙ্গে আমার এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠেছে। আমার প্রথম উচ্চারণ এ ভাষার মাধ্যমেই হয়েছে। আমার মাতৃভাষা হিসেবে এর মর্যাদা অনেক। তদুপরি এ ভাষার রয়েছে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস। এ ভাষার জন্য দিতে হয়েছে আমার ভাইয়ের বুকের তাজা রক্ত। পৃথিবীর অন্য জাতির কোনো ভাষার জন্য এ ত্যাগের ইতিহাস নেই। এ জন্য প্রতিবছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক ভাষা ও শহীদ দিবস। যেটি পালিত হয় প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে। এই একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা অনেকেই। তাই তাদের স্মরণার্থে এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
যে ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা নিজের বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিল রাজপথে। আজ সর্বত্র সে ভাষার অপমান ও লাঞ্ছনা হচ্ছে। আধুনিকমনা তরুণ প্রজন্মের শিক্ষিতরা এখন এ বাংলা বলতে লজ্জা পায়। তাদের মুখে শুধু ইংরেজিই শোভা পায়। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশ্রণকেই তারা গৌরবের কারণ মনে করে। তাছাড়া আজ সবখানে চলছে এ ভাষার বিকৃত উচ্চারণ, বিকৃত চর্চা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে এ বিকৃত উচ্চারণ। মূর্খদের কথা তো বাদই দিলাম। শিক্ষিতদের মধ্যেই চলছে আজ এ দুর্দশা। কি রাজনীতির ময়দান, বক্তৃতার মঞ্চ, বয়ান-ওয়াজের মাঠ সর্বত্রই চলছে বিকৃত ভাষা-চর্চার ছড়াছড়ি। এটাই কি ভাষার জন্য জীবন দেওয়া তাদের রক্তের মূল্য! ভাষার জন্য আত্মত্যাগের বদলা! তাদের কৃপা!
একুশে ফেব্রুয়ারির স্নিগ্ধ সকাল বেলা নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া। শহীদদের সম্মানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করাকেই অনেক গুরুত্ববহ মনে করা হয়। এটাকেই তারা সর্বোচ্চ সম্মানের কাজ মনে করে থাকে। আসলে কি এতে আদৌ তাদের রক্তের মূল্য পরিশোধ হচ্ছে? তাদের আত্মা শান্তি পাচ্ছে? এক ভাষাবিদ এ জাতির প্রতি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন ‘ভাষার জন্য জীবন দেওয়া জাতিটির ভাষার প্রতি অবিচার দেখে আমি নির্বাক।’ তাই আসুন, ভাষার মাসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, সর্বদা শুদ্ধ বাংলা চর্চা করব এবং এটাকে জীবনের অন্যতম লক্ষ্য বানিয়ে নেব। এতে সামান্য হলেও তাদের আত্মা কবরে শান্তি পাবে। ভাষার জন্য তাঁদের আত্মত্যাগের মূল্য কিছুটা হলেও পূর্ণ হবে।