খাবার গ্রহণের আদব

ইসরাত জাহান সারা

প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। মানবজাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ইসলাম যুগে যুগে নানা শরিয়ত দান করেছেন। সে ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ও সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে ইসলামকে নির্বাচন করা হয়েছে। সুরা আল ইমরানে ১৯নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন হলো ইসলাম।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯)। অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম পরিত্যাজ্য।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বকালের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তিনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী। তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কালাম : ৪)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম নমুনা বা আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)। মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে নবী করিম (সা.)-এর জীবনীতে অনুকরণীয় আদর্শ রয়েছে। খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নিম্নে খাবার গ্রহণের আদবগুলো বর্ণনা করা হলো-

খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা

রাসুল (সা.) খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতেন এবং তাঁর সাহাবিদেরও বিসমিল্লাহ বলতে বলতেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে ও ডান হাত দ্বারা খানা খাও এবং তোমার দিক থেকে খাও।’ (বোখারি : ৫১৬৭ ; তিরমিজি : ১৯১৩)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন তোমরা খানা খেতে শুরু করো তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও, তাহলে বলো, ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওআখিরাহ।’ (রিয়াজুস সালেহিন : ৭২৯)।

দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া

রাসুল (সা.) খাওয়ার সময় দস্তরখানা বিছিয়ে খেতেন। তিনি এ ব্যাপারে অনেক যত্নশীল ছিলেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) পায়াবিশিষ্ট বড় পাত্রে খাবার খেতেন না। কাতাদা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে কীসের ওপর খানা খেতেন? তিনি বললেন, ‘চামড়ার দস্তরখানের ওপর।’ (বোখারি : ৫৩৮৬)।

হাত ধুয়ে খাবার শুরু করা

খাবার গ্রহণের আগে হাত ধোয়া আবশ্যক। অন্যথায় বিভিন্ন অসুখ দেখা দিতে পারে, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। রাসুল (সা.) খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার আদেশ দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) পানাহারের আগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন। (মুসনাদে আহমাদ)।

ডান হাত দিয়ে খাওয়া

রাসুল (সা.) সবসময় ডান হাত দিয়ে খেতেন এবং ডান হাত দিয়ে খেতে সাহাবিদের উপদেশ দিতেন। তিনি বাম হাত দিয়ে খাবার খাওয়া পছন্দ করতেন না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বাম হাত দ্বারা খাবার খেয়ো না ও পান করো না। কেননা শয়তান বাম হাতে খায় ও পান করে।’ (বোখারি : ৫৩৭৬ ; মুসলিম : ২০২২)।

আঙুল ও হাত চেটে খাওয়া

আঙুল ও হাত চেটে খাওয়া সুন্নত। এর ফলে অধিক বরকত লাভ করা যায়। কেননা খাবারের বরকত কোথায় আছে তা কেউ জানে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করো তখন আঙুল চেটে খাও। কেননা বরকত কোথায় রয়েছে তা তোমরা জানো না।’ (ইবনে মাজাহ : ১৯১৪)। রাসুল (সা.) হাত চাটা ছাড়া কখনও মুছতেন না। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করবে, তখন হাত চাটা নাগাদ তোমরা হাতকে মুছবে (ধোয়া) না।’ (বোখারি : ৫২৪৫)।

হেলান দিয়ে না খাওয়া

রাসুল (সা.) কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে খাবার খেতে নিষেধ করেছেন। এর মাধ্যমে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায় এবং আল্লাহর নেয়ামতের অপমান করা হয়। আবু হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর দরবারে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বলেন, ‘আমি টেক (হেলান) লাগানো অবস্থায় কোনো কিছু ভক্ষণ করি না।’ (বোখারি : ৫১৯০ ; তিরমিজি : ১৯৮৬)।

খাবারের দোষ-ত্রুটি না ধরা

খাবারে দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। রাসুল (সা.) কখনও খাবারের দোষ ধরতেন না। তার পছন্দ হলে খাবার খেতেন নতুবা উঠে যেতেন। তিনি খাবারের দোষ বের করতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কখনও খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না। তার পছন্দ হলে খেতেন, আর অপছন্দ হলে খেতেন না।’ (বোখারি : ৫১৯৮ ; ইবনে মাজাহ : ৩৩৮২)।

খাবারে ফুঁ না দেওয়া

খাবার বা পানিতে ফুঁ দিলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাসুল (সা.) কখনও খাবারে ফুঁ দিতেন না। তিনি ফুঁ দিয়ে খাবার বা পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) কখনও খাবারে ফুঁ দিতেন না। কোনো কিছু পান করার সময়ও তিনি ফুঁ দিতেন না।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৪১৩)।

পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া

পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া সুন্নত। রাসুল (সা.) পড়ে যাওয়া খাবার তুলে পরিষ্কার করে খেতেন। রাসুল (সা.)-এর খাবারকালে যদি কোনো খাবার পড়ে যেত, তাহলে তিনি তুলে খেতেন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের খাবার আহারকালে যদি লুকমা পড়ে যায়, তাহলে ময়লা ফেলে তা ভক্ষণ করো। শয়তানের জন্য ফেলে রেখো না।’ (তিরমিজি : ১৯১৫; ইবনে মাজাহ : ৩৪০৩)।

খাবার শেষে দোয়া পড়া

খাবার আল্লাহতায়ালার নেয়ামত। আর খাবারের কৃতজ্ঞতা আদায় করলে আল্লাহ তার নেয়ামত বাড়িয়ে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেব।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। খাবার শেষে রাসুল (সা.) আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন এবং দোয়া পাঠ করতেন। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) খাবার শেষ করে বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহি হামদান কাসিরান ত্বয়্যিবান মুবারাকান ফিহি, গায়রা মাকফিইন, ওয়ালা মুয়াদ্দায়িন ওয়ালা মুসতাগনা আনহু রাব্বানা।’ তিনি আবার কখনও এই দোয়া পড়তেন : ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আতআমানা ওয়াছাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন।’ (বোখারি : ৫৪৫৮)।

রাসুল (সা.) এর সুন্নত আঁকড়ে ধরলে জীবন সুন্দর ও সার্থক হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর রাসুল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।’ (সুরা হাশর : ৭)। তিনি আরও বলেন, ‘যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আসলে আমারই আনুগত্য করল।’ (সুরা নিসা : ৮০)। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে নবীজি (সা.) এর সুন্নতের অনুসরণ ও অনুকরণে যথাযথ আমল করার তৌফিক দান করুন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নতের আঁকড়ে ধরার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল

মহিলা মাদ্রাসা