শৈশবে মাতৃভাষা শেখানোর গুরুত্ব

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যম ভাষা। মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যমও ভাষা। সৃষ্টিজগতে অগণিত প্রাণী আছে। এসব প্রাণীর মধ্যে একমাত্র মানুষই মনের ভাব পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে। কারণ মানুষের চিন্তাশক্তি আছে। চিন্তা থেকে ভাবের উদয় হয়। সেই ভাব প্রকাশ পায় ভাষার মাধ্যমে।

পৃথিবীর বুকে অগণিত ভাষা আছে। তন্মধ্যে একটি ভাষাকে প্রত্যেকের মাতৃভাষা বলা হয়। মানুষ যে ভাষা মায়ের কাছ থেকে শেখে, জন্মের পর মাকে যেভাষায় কথা বলতে দেখে ও মায়ের মুখ থেকে যে ভাষায় কথা বলা শেখে সেটিই মাতৃভাষা। আমরা জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা শিখেছি তা বাংলা। বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লোকদের ভাষাও বাংলা। আসামের লোকেরাও বাংলা বোঝে। বাংলা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত একটি ভাষা। এই স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ঘোষণার মাধ্যমে।

অনেক ভাষা মুখে বলা হয়। লেখার বর্ণ নেই। তাই লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলা ভাষা লেখাও যায়, বলাও যায়। স্বাধীনতার পর শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলনের সবচেয়ে বড় লাভ আমাদের শিশু-কিশোররা মাতৃভাষাতেই মনের সবটকু ভাব প্রকাশ করতে বিনিময় করতে এবং সবকিছু সহজে বুঝে নিতে সক্ষম হয় এবং স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো শিশু যখন বাংলার মাধ্যমে কোনো শব্দের অর্থ অনুমান করার ক্ষমতা বা লাইন বাই লাইন পড়ে অর্থ অনুমান করার দক্ষতা গড়ে তোলে, তবে তারা যখন দ্বিতীয় ভাষায় অধ্যয়ন শুরু করে তখন অতি সহজেই এই দক্ষতাগুলো স্থানান্তরিত হয়। তবে এই দক্ষতা সরাসরি দ্বিতীয় ভাষার মাধ্যমে শেখানো অনেক কঠিন। বস্তুত মাতৃভাষার ব্যবহার শিশুকে তাদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং শিক্ষার দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে।

মাতৃভাষা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। প্রথম ভাষায় শক্ত ভিত্তিযুক্ত শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের মধ্যে এবং সমাজের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্পর্কে আরও গভীর উপলব্ধি প্রদর্শন করে এবং পাশাপাশি নিজের উপর আস্থা অর্জনের বোধ বৃদ্ধি করে। স্বাভাবিকভাবেই, এটি তাদের শিক্ষাগত কৃতিত্বসহ তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রবাহিত হয়। সুতরাং শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার অনেক গুরুত্ব রয়েছে।

মাতৃভাষা শিশুদের জন্য অন্যান্য ভাষা বাছাই এবং শিখতে সহজ করে। আমাদের শিশুরা আগে বাংলা শেখে বলেই তারা অন্যান্য আরও কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। মাতৃভাষা একটি শিশুর ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বিকাশ করে। মাতৃভাষা ব্যবহার শিশুকে তাদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং শিক্ষার দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে।

মাতৃভাষায় শেখা শিশুরা তাদের পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কারণে আরও বেশি স্কুল উপভোগ করে এবং দ্রুত শিখতে পারে। এবং তারা আরও বেশি আত্মসম্মানের অধিকারী হয়। এ ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম থাকার কারণে পিতামাতার বাড়ির কাজগুলোতে সহায়তা করতে পারে। ফলে পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। যে সব শিশু বহু ভাষিকতার মাধ্যমে শেখার জন্য অর্থ উপার্জন বা ব্যয় করে তারা অতি সহজে উচ্চতর আর্থসামাজিক অবস্থান উপভোগ করতে পারে। মাতৃভাষা একটি ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা এবং ব্যক্তিত্বকে একটি দ্ব্যর্থহীন উপায়ে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। এটি তাদের বিদেশি ভাষায় পাঠ পাওয়ার এবং এর চাপ মোকাবিলা করার অপ্রয়োজনীয় চাপ থেকে বাঁচায়। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় দক্ষতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্মতা এবং পরিচয়ের বোধ তৈরি করে।

মোটকথা, মাতৃভাষা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জীবন্ত প্রতীক। মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে একটি জাতির আত্মমর্যাদা, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত সম্মান এবং বিভিন্ন জাতিগত পটভূমি গঠনে সবার জন্য সমান সুযোগ সরবরাহ করা সম্ভব হয়। মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের পর অন্যান্য ভাষায় দক্ষতা অর্জন অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। আজকে শিশুদেরকে প্রথম থেকে ইংরেজি ভাষায় বুলি শেখানোর যে প্রবণতা অভিজাত শ্রেণিকে পেয়ে বসেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় এসব শিশু নিজস্ব কৃষ্টিকালচারের কথা ভুলে যাচ্ছে। বিজাতীয় ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের মধ্যে নৈতিক স্খলন দেখা দিচ্ছে। আমাদেরকে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।