বাংলাদেশে বিসিএসসহ অনেক পাবলিক পরীক্ষায় প্রায়ই দুটি কমন প্রশ্ন করতে দেখা যায়, কোন সাগরে অথবা কোন নদীতে কোনো মাছ অথবা প্রাণী নেই? উত্তরে সোজাসাপ্টা লিখে দেয়া হয়- জর্ডান নদীতে কোনো মাছ নেই এবং ডেড-সিতে কোনো প্রাণী নেই। ডেড-সি কেন্দ্রিক উল্লিখিত প্রশ্ন ও উত্তরের ধরন দেখে মনে হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা যেন শুধু এ দুটো প্রশ্নত্তোরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
কিš‘ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ সীমাবদ্ধতার বাঁধ পেরিয়ে আমাদের আরও একটু অগ্রসর হয়ে জানতে হবে যে, এ সাগর উৎপত্তির পেছনে কী মহারহস্য লুকায়িত আছে? আরও জানতে হবে এ সাগরের উৎপত্তির সঙ্গে অতীত, বর্তমান ও অনাগত মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় কোনো দিকনির্দেশনা রয়েছে কি-না। এ প্রবন্ধে প্রথমে ডেড-সির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে।
এর পর আসমানি কিতাব আল কোরআনের বিভিন্ন সুরায় বর্ণিত হজরত লুত (আ.)-এর জাতির সমকামিতার দরুন তাদের ওপর মহান আল্লাহর গজব ও ধ্বংসাত্মক পরিণতির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর বর্তমান ভূবিজ্ঞানীদের ডেড-সি বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। উপসংহারে বর্তমান মানবসমাজের জন্য শিক্ষণীয় কিছু বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।
কেউ বলেন ডেড-সি বা মৃত সাগর আবার কেউ বলেন লুত সাগর। আসলে জায়গাটি নামে ভিন্ন হলেও প্রকৃতপক্ষে একই জায়গার দুটি ভিন্ন নাম। ডেড-সি হলো পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্ববৃহৎ গর্ত, যা দেখতে অনেকটা সাগরের মতো বলেই এ জায়গাটিকে সাগর বলা হয়। কী হয়েছিল পৃথিবীর এ অংশে, কেনই বা এরকম গর্ত বা সাগর এই এলাকায় সৃষ্টি হলো, যার অনুরূপ দ্বিতীয় কোনো নজির পৃথিবীর বুকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এরকম অনেক প্রশ্ন বহু বছর ধরেই জ্ঞানবান মানুষ থেকে শুরু করে ভূবিজ্ঞানীদেরও তাড়া করে ফিরছে।
কিন্তু মানুষ তার অতি সামান্য জ্ঞান দ্বারা প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বছর আগের প্রাচীন ইতিহাসের কতটুকুই বা বুঝতে পারবে, যদি না থাকে তার কাছে আল-কোরআনের কোনো প্রকৃত জ্ঞান। আল-কোরআনের বর্ণনা মোতাবেক ডেড-সি (লুত সাগর) হলো একটি অভিশপ্ত জায়গা, যেখানে হাজার হাজার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এক মহা-অপরাধী সম্প্রদায়কে এক মুহূর্তের মধ্যে জীবন্ত সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
বর্তমান ডেড-সি হলো উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি ভূতাত্ত্বিক বেসিন, যার পূর্ব দিকে মুসলিম রাষ্ট্র জর্ডান এবং পশ্চিম দিকে দখলদার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। ইতিহাসের বহুল পরিচিত ডেড-সির পানিস্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত ভূমধ্যসাগরের পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রায় ৩৯৭ মিটার নিচে অবস্থিত। সাগরের তলদেশটি প্রতিবছর প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার (১ ফুট) করে নিচের দিকে (ভূগর্ভে) অবনমন হ”েছ। এ সাগরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সর্বোচ্চ ১৮ কিলোমিটার।
ডেড-সি পৃথিবীপৃষ্ঠের সবচেয়ে বড় গর্ত বা গভীরতম স্থান। ডেড-সির পানি পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বাপেক্ষা লবণাক্ত পানি, যার শতকরা ৩৫ ভাগই লবণ। অন্যান্য সাগরের পানির তুলনায় এ সাগরের পানি প্রায় ৬-৮ গুণ বেশি লবণাক্ত এবং গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লবণের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। সাগরের তলদেশে লবণের ঘনত্বের পরিমাণ এত বেশি যে, এগুলো ক্রমান্বয়ে দানা বেঁধে বেঁধে স্ফটিকের স্তম্ভ আকারে সাগরের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সাগরটি চারদিকে ভূমি ও ব্যাসাল্ট পাথরের পাহাড়বেষ্টিত।
উত্তর দিক থেকে জর্ডান নদী এসে এ সাগরে পতিত হয়েছে। আবার উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে কিছু পাহাড়ি নদী জর্ডানের পশ্চিম এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেড-সির পূর্বকূলে পতিত হয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, এ সাগরের পানির পৃষ্ঠদেশ থেকে ৪০ মিটার গভীর পর্যন্ত প্রতি ১ লিটার পানি থেকে ৩০০ গ্রাম লবণ পাওয়া যায় এবং ৪০ মিটার থেকে ৩০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রতি ১ লিটার পানি থেকে ৩৩২ গ্রাম লবণ পাওয়া যায়। পানির এত অধিক ঘনত্বের কারণে যে কোনো মানুষ ইচ্ছে করলেই ডেড-সির পানিতে নিজেকে ডুব দিয়ে ধরে রাখতে পারবে না, অর্থাৎ ডেড-সির পানিতে মানবদেহ সব সময় ভাসে।
অধিক পরিমাণে লবণাক্ততার কারণে যদি কোনো মাছ জর্ডানের পাহাড়ি এলাকার স্বাদুপানির নদী থেকে এ সাগরে প্রবেশ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা মারা যায় এবং ওই মৃত মাছের দেহের ওপর তৎক্ষণাৎ লবণের পুরু আস্তরণ পড়ে ঢেকে যায়। কিছুদিন আগ পর্যন্ত মানুষ জানত যে, ডেড-সিতে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ইদানীং ডিসকভারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল থেকে সম্প্রচার করা হচ্ছে যে, এ সাগরের পানির গভীরে কিছু অ্যালজি ও ব্যাকটেরিয়ার বসবাস রয়েছে। আসমানি কিতাব আল-কোরআনের বিভিন্ন সুরায় বর্ণিত ডেড-সি (লুত সাগর) উৎপত্তির ঐতিহাসিক পটভূমি নিম্নরূপ।
মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত প্রাচীন উরনগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজে প্রথমে ইরাক থেকে মিশর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে আরবের মরুভূমির বিভিন্ন প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ কয়েক বছরকাল ঘুরে ঘুরে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার ও তাঁর হুকুম মেনে চলার পথে মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন।
অতঃপর তিনি তার এই দওয়াতের পয়গাম ও আদর্শ প্রচারের জন্য ট্রান্স-জর্ডানের বর্তমান ডেড-সি (লুত সাগর) এলাকাটিতে তার ভাতিজা হজরত লুত (আ.)-কে প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য, প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বছর আগে বর্তমান লুত সাগর (ডেড-সি) এলাকাটিতে তদানীন্তন বিশ্বের আর্থিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সর্বোন্নত অথচ নৈতিকতার দিক দিয়ে অধঃপতিত ও সর্বনিকৃষ্ট একটা জাতি বসবাস করত। পুরুষে-পুরুষে সমকামিতা, লুটপাট, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। প্রকাশ্য দরবারে, মাঠে, বিভিন্ন পার্কে দিবালোকে তারা সমকামে লিপ্ত হতো। হজরত লুত (আ.) তার এই জাতিকে বিভিন্নভাবে এহেন অপকর্ম হতে বিরত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।
কিন্তু কিছুতেই তিনি তাদের বোঝাতে ও বিরত রাখতে পারলেন না। বরং উল্টোভাবে তার জাতি তাকে দেশ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তিনি আল্লাহর কাছে এ ব্যাপারে দোয়া করলেন এবং আল্লাহ তার দোয়া কবুল করলেন। লুত জাতিকে ধ্বংসের জন্য আল্লাহতায়ালা ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতারা লুত জাতিকে ধ্বংসের আগে প্রথমেই ফিলিস্তিনের হেবরনে বসবাসরত হজরত ইবরাহিম (আ.) বাড়িতে আসেন। ফেরেশতারা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে তার দ্বিতীয়পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)-এর জন্মগ্রহণের সুসংবাদ শোনানোর পাশাপাশি হজরত লুত (আ.)-এর জাতির ওপর আসন্ন আল্লাহর গজবের দুঃসংবাদও শোনান। ফেরেশতাদের কাছে এ দুঃসংবাদ শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) লুত জাতিকে ক্ষমা করার জন্য আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করলেন; কিš‘ মহান আল্লাহতায়ালা লুত জাতির ধ্বংসের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। সন্ধ্যার দিকে ফেরেশতারা ফিলিস্তিনের হেবরন থেকে বের হয়ে লুত জাতির বসতিস্থল সাদুম ও গোমরা নগরীদ্বয়ের দিকে অগ্রসর হন।
যেহেতু নগরীদ্বয়ের লোকেরা সমকামিতার পঙ্কিলে নিমজ্জিত ছিল, তাই তিনজন ফেরেশতা, ১. হজরত জিবরাইল (আ.), ২. হজরত ইসরাফিল (আ.) এবং ৩. হজরত মিকাইল (আ.) কৌশলস্বরূপ সুদর্শন ছেলে মানুষের রূপ ধারণ করে ওই এলাকায় আসেন। সুদর্শন ছেলে মানুষরূপী ফেরেশতারা সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকারে হজরত লুত (আ.)-এর বাড়িতে পৌঁছার পরপরই হজরত লুত (আ.)-এর স্ত্রী যে কোনোভাবেই হোক বিষয়টি জানার পর সে এলাকার যুবকদের মধ্যে গোপনে তথ্যটি ছড়িয়ে দেয়।
সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শত সহস্র যুবক দল মেহমানদের সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে হজরত লুত (আ.)-এর বাড়িতে প্রবেশ করে। মেহমানদের ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে হজরত লুত (আ.) বারবার হীন অপকর্মের উদ্দেশে আসা যুবকদের নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চরিত্রহীন যুবক দল কোনোভাবেই এই মহান নবীর কথায় কর্ণপাত করল না।
এ রকম অসহায় পরিবেশে হজরত লুত (আ.) আল্লাহতায়ালার দরবারে এর একটা সমাধানের জন্য দোয়া করলেন। এক পর্যায়ে হজরত লুত (আ.)-এর কাছে ফেরেশতারা তাদের পরিচয় দিয়ে বলেন, রাত কিছুটা থাকতে অর্থাৎ ভোর হওয়ার আগেই হজরত লুত (আ.) যেন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এ এলাকা ছেড়ে চলে যান এবং কেউ যেন পেছন দিকে ফিরে না তাকায়।
তবে শর্ত ছিল যে, হজরত লুত (আ.)-এর পরিবারের মধ্য থেকে তার স্ত্রী সঙ্গে যেতে পারবে না, কারণ মহিলাটি তার জাতির সঙ্গে ধ্বংস হবে বলে আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্ত ছিল। ভোর রাতে হজরত লুত (আ.) তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ভূমিকম্প শুরু হয়। ভূগর্ভ থেকে পরিপক্ব মাটির প্রস্তর (ভূ-তাত্ত্বিক ভাষায়, অতি উত্যপ্ত লাভা) অবিশ্রান্তভাবে দুশ্চরিত্র জনতার ওপর বর্ষণ করা হয় এবং জমিনকে উল্টিয়ে তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এ সময়ে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছিল। সাদুম, গোমরা ও আশপাশের অন্যান্য পাপিষ্ঠ নগরীর জমিনকে ভূ-গর্ভে মিশিয়ে দেয়া হয়, যা বর্তমানে ডেড-সি বেসিন বা মৃত সাগর অথবা লুত সাগর নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ভূবিজ্ঞানের বর্তমান গবেষণা থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বছর আগে ডেড-সির উৎপত্তির সঙ্গে তীব্র ভূমিকম্পের সম্পর্ক ছিল। যদিও অতি প্রাচীনকালের এ ভূমিকম্পের তীব্রতা রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি, তবে ডেড-সি এলাকাটি যে একটি তীব্র ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। বর্তমানে গবেষণার সাহায্যে জানা গেছে যে, ডেড-সি এলাকাটিতে খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বিভিন্ন মাত্রার অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়েছে। অর্থাৎ ডেড-সি একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।
আল-কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, লুত জাতির ঘরবাড়ি ও বস্তি-জনপদ আকাশে তুলে উল্টিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের নিচে ফেলে চাপা দেয়া হয়েছিল। ডেড-সির মতো একটি দৃশ্যমান নিদর্শনকে সামনে রেখে পরবর্তী মানবজাতিকে এ শিক্ষা নেয়ার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, সমকামিতার মতো অতি জঘন্য আপরাধ যদি কোনো জাতি করে, তাহলে লুত জাতির মতো পরিণতি তাদেরও হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে এ অপকর্ম অনেক দেশে বেড়ে চলেছে ও বৈধতা পাচ্ছে।
লেখক : বিজ্ঞানী; অধ্যাপক, পেট্রলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট