কোরআন ও বিজ্ঞানের আলোকে সমুদ্র ও মহাসমুদ্র

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবী পৃষ্ঠের ৪ ভাগের ৩ ভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে পানি। এই পানির বিরাট অংশ দখল করে আছে সাগর ও মহাসাগর। এই সাগর শব্দটি পবিত্র কোরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ২৫টি সূরায় ৪০ বার এসেছে। পাঠকের পড়ার সুবিধার জন্য এখানে ওইসব সুরা এবং আয়াতগুলোর ক্রমিক নম্বরগুলো উল্লেখ করা হলো :

২:৫০, ১৬৪; ৫:৯৬, ১০৩; ৬:৫৯, ৬৩, ৯৭; ৭:১৩৮, ১৬৩; ১০:২২, ৯০; ১৪:৩২; ১৬:১৪; ১৭:৬৬, ৬৭, ৭০; ১৮:৬০, ৬১, ৬৩, ৭৯, ১০৯; ২০:৭৭; ২২:৬৫; ২৪:৪০; ২৫:৫৩; ২৬:৬৩; ২৭:৬১, ৬৩; ৩০:৪১; ৩১:২৭, ৩১; ৩৫:১২; ৪২:৩২; ৪৪:২৪; ৪৫:১২; ৫২:৬; ৫৫:১৯, ২৪; ৮১:৬; ৮২:৩।

কোরআনে বর্ণিত এইসব বক্তব্য বুঝতে হলে বিজ্ঞানধর্মী জ্ঞানের একান্ত প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে কোরআনে বর্ণিত সাগর সম্পর্কে অনেক আয়াত থেকে মাত্র একটি আয়াতের আলোচনা করা হলো। তাতে রয়েছে সাগরের স্তরীভূত অন্ধকার (২৪:৪০) প্রসঙ্গে সাগরের গভীর থেকে গভীরতায় বিভিন্ন রংয়ের শোষণ, আলোর প্রস্থান এবং অন্ধকারের আবির্ভাব নিয়ে।

মহাগ্রন্থ আল কোরআন একটি অলৌকিক গ্রন্থ। মানবজাতি এবং জিনদের পক্ষে এই কোরআনের মতো একটি সুরাও রচনা করা সম্ভব নয়। এই গ্রন্থের বহু জায়গায় এই নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ১৪শ বছর ধরে এই চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করতে পারেনি এবং কোনো দিন পারবেও না। কোরআনের অলৌকিকত্ব চিরদিনের এবং পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে এর অলৌকিকত্ব বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞানের আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটে উদ্ভাসিত হতে থাকবে।

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি গভীর সাগর-মহাসাগরের গভীরতা এবং তার বৈশিষ্ট্যাবলি। পবিত্র কোরআনের ২৪নং সুরা নুরের ৪০নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,

‘অথবা (অবিশ্বাসীদের অবস্থা) মহাগভীর সমুদ্র তলের অন্ধকারের মতো, যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ, যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ, গাঢ় অন্ধকার স্তরের উপর স্তর, যদি একজন মানুষ হাত বাড়ায় তা আদৌ সে দেখতে পাবে না, আল্লাহ যাকে আলো দান করেন না তার জন্য কোন আলো নেই।’

কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির মেরিন জিওলজির বিশেষজ্ঞ প্রফেসর দূর্গা রাও (Professor Durga Rao)-কে বিজ্ঞানবিষয়ক কোরআনের আয়াতগুলো থেকে উপরের আয়াতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, বিজ্ঞানীরা সাবমেরিনের সাহায্যে বর্তমানে সাগরের তলদেশের অন্ধকার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছে এবং গভীর সাগরে ডুব দিয়ে থাকতে সক্ষম হয়েছে। যারা সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্তার জন্য ঝিনুক কুড়ায় তারা শুধু কম গভীরতায় (২০-৩০ মিটার) ওই কাজ করতে পারে। মানুষ সমুদ্রের ২০০ মিটার গভীরতার অন্ধকার অংশে বাঁচতে পারে না। উপরের বর্ণিত আয়াত গভীর সমুদ্রের একটি চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। শুধুমাত্র গভীর মহাসমুদ্রে ওই রকম স্তরীভূত অন্ধকার সৃষ্টি হওয়ার পেছনে দুটি কারণ অন্তর্নিহিত আছে।

প্রথম কারণ

আলোক রশ্মি সাতটি রংয়ের (VIGROBY) সমন্বয়ে গঠিত। যখনি আলোক রশ্মি পানিতে এসে পড়ে তখন তা সাতটি রংয়ে বিন্যাস্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে শোষিত হয়ে সমুদ্রের গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। প্রথম উপরিস্তরের ১০ মিটারে লাল রং শোষিত হয়। কোন ডুবুরী সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরি ভাগের ৩০মিটার গভীরে যদি কোন আঘাত পেয়ে শরীর থেকে রক্ত বের হয় তা সে দেখতে পাবে না। কারণ ওই গভীরতায় আলোর লাল রং পৌঁছায় না। ওই ভাবে দেখা যায় পরবর্তী গভীরতায় (৩০-৫০ মিটার) কমলা রং শোষিত হয়ে যায়। ৫০-১০০ মিটার গভীরতায় হলুদ রং শোষিত হয়। ১০০-২০০ মিটার গভীরতায় সবুজ রং এবং ২০০ মিটার এর বাইরে গভীরতায় নীল রং শোষিত হয়। বেগুনি এবং ইনডিগো ২০০ মিটার উপরে শোষিত হয়। এভাবে একের পর এক সব রং শোষিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সাগরের এক এক স্তরে এক এক রং শোষিত হওয়ার ফলে স্তরীভূত অন্ধকার সৃষ্টি হয় এবং তলার দিকে অন্ধকার ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হয়ে সব শেষে কঠিন অন্ধকার আবির্ভূত হয়। ১০০০ মিটারের নিচে সম্পূর্ণ অন্ধকার।

দ্বিতীয় কারণ

বাঁধা প্রাপ্ত হওয়ার কারণে আলো লুকিয়ে যায়, ফলে অন্ধকার ঘনীভূত হয়। আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠে যে আলোক রশ্মি দেখি তার উৎস হলো সূর্য। আকাশে মেঘ থাকলে এই আলোক রশ্মি প্রথম মেঘে বাধাপ্রাপ্ত হয়। কারণ মেঘের মধ্যে পানির বিন্দুতে আলো শোষিত হয় এবং কিছু আলোক রশ্মিতে বিন্যস্ত হয়। যার ফলে মেঘের নিচে অন্ধকার স্তরের সৃষ্টি হয়। তা হলো অন্ধকারের প্রথম স্তর। আলোক রশ্মি যখন সমুদ্রের পৃষ্ঠদেশে পতিত হয় তখন তা সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে প্রতিফলিত হয়ে উজ্জ্বলতা প্রদর্শন করে। উজ্জলতার প্রতিফলনের মাত্রা ঢেউয়ের কোণের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে। ফলে তরঙ্গসমূহ আলোকে প্রতিফলিত করে উপরে নিক্ষেপ করার ফলে নিচে অন্ধকার সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের গভীরে কেবল অপ্রতিফলিত রশ্মিগুলো প্রবেশ করে। এভাবে সমুদ্রকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- আলো ও গরম তাপমাত্রা সম্পন্ন উপরিভাগ এবং অন্ধকারসম্পন্ন গভীর স্তরগুরো। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে এই দু’স্তর এক অন্যের থেকে পৃথক এবং উপরিভাগ তরঙ্গের মাধ্যমে গভীর স্তর থেকে পুনরায় পৃথক।

সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা ও অন্ধকারের স্বরূপ

সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা সবেমাত্র ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে যে সমুদ্রের গভীরেও তরঙ্গ রয়েছে, যা ঘন ইন্টারফেসের উপর বিভিন্ন ঘনত্বের তরঙ্গের মধ্যে সংঘটিত হয়। অভ্যন্তরীণ তরঙ্গগুলো সাগর এবং মহাসাগরের গভীর অংশকে দখল করে থাকে। কারণ গভীর অংশের পানি অধিকতর ঘনত্ব সম্পন্ন। উপরিভাগের ঢেউয়ের মতো এগুলো ভাঙতে পারে। অভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা মানুষের চোখে দেখা যায় না। কিন্তু গভীরতার নির্দিষ্ট অবস্থানের তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ওইসব তরঙ্গ শনাক্ত করা যায়। সমুদ্রের দুই স্তর পৃথককারী ওই সব তরঙ্গের নিচ থেকে অন্ধকার শুরু হয়। এই সব গভীর অঞ্চলে বসবাসকারী মাছও কিছু দেখতে পায় না। ওই স্তরে (মাছের) তাদের শরীরের নিজস্ব আলোক অঙ্গ থেকে বিচ্ছুুরিত আলোতে তারা পথ চলে। একের উপর আরেক স্তরীভূত অন্ধকার সম্পর্কে কোরআন বলছে- ‘গভীর মহাসমুদ্র অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয় বিশাল তরঙ্গের নিচে তরঙ্গ দ্বারা।’ (২৪:৪০)।

ওইসব তরঙ্গের ওপর আরও সমান্তরাল অন্ধকার স্তর আছে। এই অন্ধকার স্তরগুলি সমুদ্র সারফেসের উপর স্থান লাভ করেছে। কোরআন আমাদেরকে ওই অন্ধকার সম্পর্কে জানাচ্ছে, ‘যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ; গাঢ় অন্ধকার স্তরের উপর স্তর।’ (২৪:৪০)।

সমুদ্রের বিভিন্ন স্তরে আলোক রশ্মির বিভিন্ন রং শোষিত হওয়ার পর যে অন্ধকার সৃষ্টি হয় তার অতিরিক্ত মেঘের নিচে এই অন্ধকার। সমুদ্রের বিশাল গভীর অন্ধকারের অবস্থা বুঝতে গিয়ে কোরআন বলছে, ‘(ওই গভীরতায়) যদি একজন মানুষ হাত বাড়ায় সে ঐ হাত আদৌ দেখতে পাবে না (অর্থাৎ অতি নিকটতর বস্তু)। আল্লাহ যাকে আলো দান করেন না তার জন্যে কোন আলো নেই।’ (২৪:৪০)।

এই স্তর হলো সম্পূর্ণ অন্ধকার স্তর। এই জন্যেই গভীর সমুদ্রের তলদেশে সাবমেরিনকে অবশ্যই তাদের নিজস্ব আলো সঙ্গে নিতে হয়।

আল-কোরআনের উৎস কোথায়?

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সাগরের গভীরতার এসব স্তরীভূত অন্ধকারের খবর কে দিলেন? ১৪শ বছর আগে আধুনিক বিজ্ঞানের এই জ্ঞান তিনি জানলেন কেমন করে? পবিত্র কোরআনে এই সব বৈজ্ঞানিক তথ্য পৌঁছাল কী করে? এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রফেসর রাও বলেন, ১৪শ বছর আগে আধুনিক বিজ্ঞানের এসব তথ্যের উপস্থিতি ছিল, এটা ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন। তখনকার মানুষের সহজ সরল ধারণা ছিল, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার ছিল। একজন সাধারণ মানুষ সাগরের গভীরে অন্ধকার সংঘটিত হওয়ার ক্রিয়াকলাপ প্রপঞ্চের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারে না। সুতরাং আমি (প্রফেসর রাও) মনে করি যে, এ সব তথ্য একটি সুপার ন্যাচারাল উৎস থেকে এসেছে। হ্যাঁ, এই জ্ঞানের উৎস মানুষের ক্ষমতার বাইরে।

প্রফেসর রাও যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, এটি এমন একটি ব্যাপার যা প্রাকৃতিকভাবে কোন জীবের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এটি সত্যিকার অর্থে তাঁরই বক্তব্য যিনি প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রকৃতিকে জানেন, জানেন মহাবিশ্ব এবং তার গোপন বিষয়াদি। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক কোরআনে আমাদেরকে জানাচ্ছেন, ‘বল, এটা তিনি অবতীর্ণ করেছেন যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমুদয় রহস্য অবগত আছেন নিশ্চয়; তিনি পরম ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (২৫:৬)।