হিজরি বর্ষের নবম মাস রমজান। এ মাস রহমত, বরকতে পরিপূর্ণ। নবীজি (সা.) বলেন, ‘রমজান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়।’ (মুসলিম : ১০৭৯)। বান্দার আত্মশুদ্ধির এক বিশেষ মাধ্যম রমজান মাস। ঈমানকে উজ্জীবিত করার মহাসুযোগ রয়েছে এ মাসে। পবিত্র কোরআন মাজিদ এ মাসে অবতীর্ণ হয়। আল্লাহতায়ালা বান্দাকে দুষ্ট জিন ও শয়তানের অনাচার থেকে মুক্ত রাখেন এ মাসেই। এ মাসে যেমন রয়েছে ব্যাপক রহমত, তেমনি রয়েছে গোনাহ মাফ ও মুক্তির উপায়। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় ও জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে আবদ্ধ করে রাখা হয়।’ (বোখারি : ১৮৯৮)। রমজান মাস মুুসলমানের কাছে ইবাদতের উৎসব। এ মাসে প্রত্যেক আমলে অনুভূত হয় আত্মতৃপ্তি। অন্য সময় ফরজ বিধানে অলসতা, অবহেলা হলেও এ মাসের জন্য সব কর্মব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে রাখে প্রত্যেক মুসলমান। কারণ, এ মাসে রয়েছে লাভে লাভ। একে দ্বিগুণ সওয়াব, অফুরন্ত, অগণিত প্রতিদান। যেমন- নবীজি (সা.) বলেন, ‘রমজানের ওমরা হজ সমতুল্য।’ (তিরমিজি : ৯৩৯)।
যাদের ওপর রোজা ফরজ
প্রত্যেক নর-নারীর ওপর ইসলামের হুকুমণ্ডআহকাম মানা ফরজ। ফরজ হুকুম পালনে অস্বীকার ও অবহেলা করা মারাত্মক অপরাধ। নামাজ, হজ, জাকাতের মতো রমজানের রোজাও অন্যতম ফরজ এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থবান নারী-পুরুষ মুসলমানের ওপর রোজা রাখা আবশ্যক। শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া রোজা ভঙ্গ করা বড় অপরাধ। অসুস্থ, অপ্রাপ্তবয়স্ক, ঋতুবতী নারীর ওপর রোজা রাখা ফরজ নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। রমজান মাস ছাড়াও মুসলমানরা রোজা পালন করতে পারে নির্দিষ্ট নিয়মনীতিতে। তাতে রয়েছে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ। সব রোজার নিয়ম অভিন্ন হলেও ফরজ রোজার প্রতিদান অন্যসব রোজা থেকে আলাদা। এমনকি বাকি সব রোজা থেকে রমজানের রোজার ওপর রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বান্দার লৌকিক কোনো ইবাদতই আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। সুতরাং অন্যান্য ইবাদতের মতো রোজা পালনও একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্য হতে হবে। তবেই রয়েছে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও বিশেষ প্রতিদান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় রোজা আমার জন্য, আর এর প্রতিদান আমিই দেব।’ (মুসলিম : ১১৫১)।
রোজা অবস্থায় করণীয়-বর্জনীয়
রোজাদার ব্যক্তি নিয়তের সঙ্গে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকবে। এমনকি গালমন্দ ও অহেতুক কথাবার্তাও রোজার বিশুদ্ধতায় সন্দেহের কারণ হয়। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো দিন রোজা অবস্থায় ভোরে উপনীত হয়, সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা ও জাহেলি আচরণ না করে। যদি কেউ তাকে গালাগাল করে বা তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে উদ্যত হয়, তখন সে যেন বলে, আমি রোজা পালনকারী, আমি রোজাদার।’ (মুসলিম : ২৫৯৩)। রমজানে রাসুল (সা.) বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত ও দান-সদকা করতেন। সুতরাং দিনের বেলা রোজা রাখার পাশাপাশি রাতে তারাবির সালাত আদায়ে যত্নবান হওয়া চাই। আল্লাহতায়ালার কাছে বেশি করে গোনাহ মাফের দোয়া করতে হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের প্রত্যেক দিন ও রাতে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন ও মোমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)।
রোজার ফজিলত
প্রতি কর্মে অতিরিক্ত মুনাফা কে না পছন্দ করে! সবাই চেষ্টায় থাকে, কীভাবে নিজ সম্পদের ঊর্ধ্বগতি হয়। বিভিন্ন উৎসবে শ্রমিকরা উপার্জন করে থাকে পারিশ্রমিকসহ মুনাফা পাওয়ার আশায়। অনুরূপ রমজান ইবাদতের বিশেষ মৌসুম। রমজানে ঈমানদারের প্রতি আমলে অর্জিত হয় বাড়তি সওয়াব। নবীজি (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করল।’ (সুনানে বাইহাকি : ৩০৬)। অপর হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, বান্দা একমাত্র আমার জন্য পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকে। রোজা আমার জন্যই, আর নেক আমলের বিনিময় তার দশ গুণ।’ (বোখারি : ১৮৯৪)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির আশায় রোজা রাখবে এবং তারপর তার মৃত্যু হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৩২৪)।
রোজা না রাখার শাস্তি
রমজানের রোজা পালনকারীর জন্য যেমন রয়েছে সুসংবাদ, তেমনি ওজর ছাড়া রোজা ভঙ্গকারীর জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি নবীজি (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম, আমার কাছে দু’জন লোক এলো। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক পাহাড়ে নিয়ে এলো। তারপর আমাকে বলল, ‘আপনি পহাড়ের ওপর উঠুন।’ আমি বললাম, ‘আমি তো উঠতে পারব না।’ তারা বলল, ‘আমরা আপনাকে সাহায্য করব।’ আমি ওপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছুলাম, হঠাৎ কিছু লোককে দেখতে পেলাম। তাদেরকে নিজ পায়ের মাংসপেশি দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, ‘এরা কারা?’ তারা বলল, ‘যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোজা ভেঙে ফেলে।’ (সুনানে নাসায়ি : ৩২৮৬)। আলী (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত রমজান মাসের একটি রোজা ভেঙে ফেলবে, সে আজীবন সেই রোজার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৯৮৭৮)।