মাহে রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল সালাতুত তারাবি। তারাবি রোজার বিশেষ অনুষঙ্গ। তারাবি আরবি শব্দ। যার অর্থ অবসাদ দূর করা, বিশ্রাম করা ইত্যাদি। যেহেতু ২০ রাকাত তারাবিতে চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করা হয়, এ জন্য এ নামাজকে তারাবির নামাজ বলা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এ প্রবণতা বিরাজমান যে, তারাবি মানে তাড়াতাড়ি পড়তে হবে। চার রাকাত পরপর বিশ্রাম তো দূরের কথা, নামাজ যেন বিদ্যুৎ গতিতে পড়া হয়। রুকুণ্ডসেজদা তো ঠিকমতো আদায় করা হয়ই না, এমনকি কখনও দ্রুত তেলাওয়াত করতে গিয়ে কোরআনের শব্দ বিকৃত হয়ে যায়।
মোমিনের প্রশান্তি যাতে
যে ইমাম দ্রুত পড়াতে পারেন, তাকে বাহ্বা দেওয়া হয়। ফাইভজি হুজুর ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পক্ষান্তরে যে ইমাম ধীর-স্থিরভাবে আদায় করেন, তাকে তিরস্কার করা হয়। এটা শরিয়তে কাম্য নয়। নামাজ পড়া হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। একাগ্র চিত্তে ধীরস্থিরতার সঙ্গে নামাজ পড়া ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। আর মোমিন ব্যক্তি তো সারাদিন রোজা রাখার পরও ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় দাঁড়িয়েও তারাবির নামাজে আল্লাহর পবিত্র কালাম শ্রবণে প্রশান্তি লাভ করে।
তারাবির বিধান
২০ রাকাত তারাবির নামাজ নারী-পুরুষ সবার জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা। বিনা ওজরে কেউ ছাড়লে গোনাহগার হবে। আর জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়াহ। মহল্লার কেউ যদি না পড়ে, তাহলে সবাই গোনাহগার হবে। রমজান মাসে তারাবি নামাজের মধ্যে একবার কোরআন খতম করা সুন্নত। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৪৪, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ১/১১৬)।
তারাবির গুরুত্ব
তারাবির নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। তারাবির গুরুত্ব বোখারির এ হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাসুল (সা.) উম্মতের ওপর ফরজ হওয়ার আশঙ্কায় তারাবি ধারাবাহিকভাবে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আদায় করেননি। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এক রাতে মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করছিলেন। কিছু লোক তার সঙ্গে সালাত আদায় করল। পরবর্তী রাতেও তিনি তারাবির নামাজ আদায় করলেন। লোক আরও বেড়ে গেল। অতঃপর তৃতীয় কিংবা চতুর্থ রাতে লোকজন সমবেত হলেন; কিন্তু রাসুল (সা.) বের হলেন না। সকাল হলে তিনি বললেন, ‘তোমরা যা করেছ, আমি লক্ষ্য করেছি। তোমাদের কাছে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে এ আশঙ্কাই আমাকে বাধা দিয়েছে যে, তোমাদের ওপর তা ফরজ হয়ে যাবে।’ এটা ছিল রমজান মাসের ঘটনা। (বোখারি : ১১২৯)।
তারাবির ফজিলত
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে, তার আগের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় ইবাদতে (তারাবির সালাতে) রাত কাটাবে, তার আগের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ১৮০২, ১৯১০)।
তারাবির রাকাত সংখ্যা
রাসুল (সা.) তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়েছেন। তবে উম্মতের ওপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে পড়েননি। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) নিয়মতান্ত্রিক ২০ রাকাত তারাবি চালু করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) রমজান মাসে ২০ রাকাত এবং বিতির পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৫/২২৫)। উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ওমর (রা.) আমাকে এ মর্মে আদেশ দিলেন যে, আমি যেন লোকদের নিয়ে তারাবি পড়ি। তখন ২০ রাকাত পড়া হতো। (কানযুল উম্মাল : ৮/২৬৪)। ওমর (রা.) যা করেছেন বা যা করার নির্দেশ দিয়েছেন, তা বিদাত নয়, সুন্নত। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৩/৯৭৩)।
লেখক : শিক্ষক, শেখ জনূরুদ্দীন (রহ.) দারুল কুরআন মাদ্রাসা, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা