ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোজা কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়

আবদুল কাইয়ুম শেখ
রোজা কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়

সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ১২-১৪ ঘণ্টা পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা অবশ্যই কষ্টকর। অবশ্য এই কষ্ট আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং তাঁর নির্দেশ পালন করার নিমিত্তে। সৃষ্টি করার পর মহান আল্লাহ নিজের বান্দা ও গোলামের ওপর যে কোনো বিধান আরোপ করার অধিকার রাখেন। কিন্তু এ সহজ বিষয়টি বুঝতে না পেরে নির্বোধ, উদ্যত, অহংকারী ও নাফরমান কিছু লোক বলে বেড়ায়, সিয়াম সাধনার মতো কষ্টকর বিধান আরোপ করে আমাদের কষ্ট দিয়ে আল্লাহর লাভ কী? (নাউজুবিল্লাহ)। রোজা রাখা অবশ্যই কষ্টকর। কিন্তু এই রোজার মধ্যে আল্লাহতায়ালা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বহুবিধ উপকারিতা রেখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোজাদারদের কষ্ট লাঘব করার বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছেন।

রোজার ইতিহাস বর্ণনা

যদি কোনো ব্যক্তি একাকীভাবে কষ্টকর কোনো কাজ করে, তাহলে তার কষ্ট বেশি হয়। কিন্তু কেউ যদি কষ্টকর কাজে অন্য কাউকে সঙ্গী হিসেবে পায়, তাহলে কষ্টকর কাজটি তার জন্য অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়। তাই আল্লাহতায়ালা মুসলমান জাতির ওপর রোজার বিধান আরোপ করে তাদের এ বলে সান্ত¡না দিয়েছেন, রোজা শুধু তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়নি; বরং তোমাদের আগে যত জাতি গত হয়েছে, তাদের সবার ওপর রোজার বিধান আরোপ করা হয়েছিল। অতএব, তোমরা মনে করো না, রোজার মতো কষ্টকর বিধানটি আমরাই পালন করছি; অন্যান্য জাতিকে রোজার কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ওপরও রোজা রাখা ফরজ ছিল। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ওপর রোজা রাখা আবশ্যক করার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।

রোজাদারকে সান্ত¡না দান

যদি কোনো ব্যক্তি বালা-মসিবতে পড়ে কিংবা কোনো ধরনের কষ্টে নিপতিত হয়, তাহলে তাকে সান্ত¡না দেওয়া হলে তার কষ্ট বহুলাংশে লাঘব হয়ে যায়। রোজার বিধান আরোপ করার পর রোজাদারের কষ্ট লাঘব করার জন্য আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের সান্ত¡না দিয়ে বলেছেন, গণনার কয়েকটি দিন রোজা রাখবে মাত্র। রোজা রাখা শুরু করে দেখ, গণনা করতে করতেই রমজান মাস শেষ হয়ে যাবে। রোজা রাখার মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে বলেও মহান আল্লাহ রোজাদারদের সান্ত¡না দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর; যদি তোমরা তা বুঝতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)।

সাহরি খাওয়ার নির্দেশ

সাহরি না খেয়ে রোজা রাখলে তুলনামূলকভাবে রোজাদারের কষ্ট বেশি হয়। আর রোজাদারকে কষ্ট দেওয়া ইসলামে কাম্য নয়। তাই মহানবী (সা.) রোজাদারদের সাহরি খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যদি রোজাদারদের কষ্ট দেওয়া উদ্দেশ্য হতো, তাহলে নিশ্চয় সাহরি খাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হতো না। রোজাদারের কষ্ট যেন কম হয় তাই হাদিস শরিফে রাতের বেলা সাহরি খাওয়া এবং দিনের বেলা বিশ্রাম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে দিবসে রোজা রাখার জন্য এবং দিনে বিশ্রামের মাধ্যমে রাতে নামাজ পড়ার জন্য সাহায্য গ্রহণ কর।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯৩)। অন্য আরেকটি হাদিসে সাহরিতে বরকত রয়েছে অভিহিত করে তা খাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ (মুসলিম : ২৪৩৯)।

অসুস্থ ও মুসাফিরকে অবকাশদান

কিছু কিছু অসুস্থতা এমন রয়েছে, যেগুলো নিয়ে রোজা রাখলে অসুস্থ ব্যক্তির নিতান্ত কষ্ট হয়। এমন অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা রোজা না রাখার অবকাশ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সফরে থাকে, তাকে বিভিন্ন কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হতে হয়। সফর অবস্থায় রোজা রাখলে কষ্ট হয়। অসুস্থ ব্যক্তি ও মুসাফির ব্যক্তির যেন কষ্ট না হয়, তাই তাদের আল্লাহতায়ালা রোজা না রাখার ছাড় দিয়েছেন। অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর এবং মুসাফির ব্যক্তি সফর সমাপ্ত করার পর তাদের রোজা সম্পন্ন করবে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

না খেয়ে ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখা নিষিদ্ধ

রোজার বিধান আরোপ করার মাধ্যমে যদি বান্দাদের কষ্ট দেওয়া উদ্দেশ্য হতো, তাহলে বলা হতো- যে ব্যক্তি না খেয়ে যত বেশি রোজা রাখবে, তার তত বেশি সওয়াব হবে। কিন্তু রোজাদারকে কষ্ট দেওয়া উদ্দেশ্য নয় বিধায় না খেয়ে ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখতে হাদিস শরিফে নিষেধ করা হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) লোকদের ওপর দয়াপরবশ হয়ে তাদের সওমে বেসাল (ধারাবাহিকভাবে না খেয়ে রোজা রাখা) আদায় করতে নিষেধ করলে তারা বলল, ‘আপনি যে সওমে বেসাল আদায় করে থাকেন!’ তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের মতো নই, আমার প্রতিপালক আমাকে পানাহার করান।’ (বোখারি : ১৯৬৪)।

যথাসময়ে ইফতারের নির্দেশ

যদি রোজাদারকে কষ্ট দেওয়া উদ্দেশ্য হতো, তাহলে বলা হতো- যে ব্যক্তি যত দেরিতে ইফতার করবে, তার তত বেশি সওয়াব হবে। কিন্তু সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ইফতারের নির্দেশ দিয়েছে। তাই রোজাদারের জন্য সমীচীন হলো, সূর্যাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। যথাসময়ে ইফতার করাকে রোজাদারের জন্য কল্যাণকর বলে হাদিস শরিফে এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যতদিন পর্যন্ত লোকেরা যথাসময়ে ইফতার করবে, ততদিন পর্যন্ত তারা কল্যাণের সঙ্গে থাকবে। তাই তোমরা যথাসময়ে ইফতার কর। কারণ, ইহুদিরা বিলম্বে ইফতার করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯৮)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত