ইতেকাফ আত্মরক্ষার মহাপথ্য
ওমর ইবনে আখতার
প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত মাস রমজান। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পরম কাঙ্ক্ষিত ও গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিবিজড়িত পবিত্র মাস। আল্লাহতায়ালার বিশেষ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বারিধারায় বিধৌত হয়ে পাপের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ হওয়ার মাস। এ মহান লক্ষ্যের চূড়ান্ত পর্ব হচ্ছে নাজাত তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তি, যা বিশেষভাবে হয়ে থাকে রমজানের শেষ দশকে। ইতেকাফ হচ্ছে সে লক্ষ্যে সফল হওয়ার বিশেষ আয়োজন। আতা আল খোরাসানি (রহ.) বলেন, ‘ইতেকাফকারী সেই ব্যক্তির মতো, যে নিজেকে সোর্পদ করে দিয়েছে দয়াময় আল্লাহর অভিমুখে এবং বলছে, আমি এ স্থান ত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আমাকে ক্ষমা করা হয়। আল্লাহর ঘরে ইবাদতে মশগুল থাকার মাধ্যমে ইতেকাফে বান্দা নিজের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে।’ (বাদায়েউস সানায়ে)। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মহান আল্লাহর সঙ্গে আত্মার ও দিলের সুসম্পর্ক, গভীর বন্ধন আর ভালোবাসা সৃষ্টি করাই হচ্ছে ইতেকাফের উদ্দেশ্য। সব ব্যস্ততা, কোলাহল ও অবাঞ্ছিত কাজ থেকে মুক্ত হয়ে মগ্ন হওয়া এক আল্লাহর ধ্যানে। পার্থিব সমুদয় সংস্রব ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সান্নিধ্যে এসে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা দয়াময়ের সঙ্গে। (যাদুল মায়াদ)। ইতেকাফ এক শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কারণ, ইতেকাফে পার্থিব জগতের সব মায়াজাল ছিন্ন করে নিজেকে সমর্পণ করতে হয় মহান আল্লাহর দরবারে। একমাত্র তাঁরই দুয়ারে পড়ে থাকতে হয়। তাঁরই ধ্যানে মগ্ন থাকতে হয়।
ইতেকাফের পরিচয় ও ধরন
ইতেকাফ অর্থ অবস্থান করা। সওয়াবের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করাকে ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় ইতেকাফ। ইতেকাফ তিন ধরনের- ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল। কেউ যদি ইতেকাফের মানত করে, তাহলে তা ওয়াজিব হয়। রমজানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থান করা হলো সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। আর যে কোনো সময়, হোক অল্প বা অধিক, মসজিদে প্রবেশের সময় নফল ইতেকাফের নিয়ত করলে এর সওয়াব মিলবে। নফল ইতেকাফের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট সময়।
রমজানে ইতেকাফের বিধান
রমজানের শেষ দশকে অর্থাৎ বিশ রমজান থেকে নিয়তসহ সূর্যাস্তের আগে মসজিদে প্রবেশ করে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার আগ পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করা বা ইতেকাফ করা হলো সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে একজন ব্যক্তি ইতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর যদি মহল্লাবাসীর কেউ-ই ইতেকাফ না করে, তাহলে সবাই গোনাহগার হবে। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যিনি বা যারা আদায় করবেন, শুধু তিনি বা তারাই সওয়াবের অধিকারী হবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন আমি কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের জায়গা বানাও এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরের তওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুণ্ডসেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। আর যতক্ষণ তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মিশো না। এ হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতগুলো মানুষের জন্য বর্ণনা করেন; যাতে তারা তাকওয়া লাভ করতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আজীবন রমজানের শেষ দশকগুলো ইতেকাফ করেছেন। তার ওফাতের পর তার স্ত্রীরা ইতেকাফ করতেন। (বোখারি ও মুসলিম)।
নারীদের ইতেকাফ
পুরুষদের মতো নারীরাও পারেন ইতেকাফ করতে। তবে নারীরা ইতেকাফ করবে নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে। সেই ঘর থেকে বের হবে না প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও একান্ত কাজ ছাড়া। রাসুল (সা.)-এর সহধর্মিণীরা ইতেকাফ করেছেন। এ ব্যাপারে আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তার ওফাত পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ করতেন। তার ওফাতের পর তার স্ত্রীরা ইতেকাফ করেছেন। (বোখারি ও মুসলিম)।
ইতেকাফের গুরুত্ব
পবিত্র রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফের একটি মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান। শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর যে কোনো একটিতে হতে পারে লাইলাতুল কদর। একজন মানুষের ইতেকাফে থাকা পুরো সময়টাই গণ্য হয় ইবাদত হিসেবে। ফলে যে রাতেই কদর হোক, ইতেকাফকারীরা পেয়েই যান লাইলাতুল কদরের ফজিলত। তাই লাইলাতুল কদর প্রাপ্তিতে ইতেকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। লাইলাতুল কদরের খোঁজে প্রিয়নবী (সা.) ইতেকাফ করতেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) রমজানের প্রথম দশ দিনে ইতেকাফ করেছেন। তারপর তিনি একটি তুর্কি ছোট তাঁবুতে ইতেকাফ করেছেন মধ্যের দশ দিন। অতঃপর তিনি তার মাথা (তাঁবুর বাইরে) বের করে বলেছেন, আমি কদর রজনী সন্ধান করার জন্য প্রথম দশ দিনে ইতেকাফ করেছি। তারপর করেছি মাঝের দশ দিনে। তারপর আমার কাছে ফেরেশতা এসেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ দিনে। অতএব, যে আমার সঙ্গে ইতেকাফ করতে চায়, সে যেন শেষ দশ দিনে করে। (বোখারি ও মুসলিম)। পবিত্র রমজানের প্রকৃত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ এবং সময়ের সর্বোত্তম আর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে অশেষ সওয়াব অর্জনের এবং পাপের পঙ্কিলতা থেকে আত্মরক্ষার এক উত্তম ও সুপরিকল্পিত পদ্ধতি ইতেকাফ। গুরুত্ব ও আগ্রহের সঙ্গে এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করা চাই।