ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যানজট ও বায়ুদূষণে স্থবির পরিবেশ

মিনহাজুল আরিফীন
যানজট ও বায়ুদূষণে স্থবির পরিবেশ

বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি জনবহুল দেশ। নানা সমস্যায় জর্জরিত এ দেশে বর্তমানে অন্যতম একটি সমস্যা হলো ট্রাফিক জ্যাম বা যানজট। দেশের বিভিন্ন শহরে যানজটের কমবেশি চিত্র চোখে পড়লেও রাজধানী ঢাকায় তা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। যানজটের তীব্রতায় ঢাকা শহরের বসবাসকারীরা এখন চরম দুর্ভোগের শিকার। যানজটের কবলে পড়ে দেশের পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ব্যবস্থা সবই এখন হুমকির মুখে। রাজধানীর গতিময় যান্ত্রিক জীবন এখন থমকে দাঁড়ায় শুধু যানজটের কাছে। ফলে ২০১৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ যানজটপূর্ণ শহরের উপাধিও জুটেছে রাজধানী ঢাকার কপালে। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর প্রকাশিত ‘ট্রাফিক ইনডেক্স ২০১৯’-এ কলকাতাকে পিছিয়ে ফেলে শীর্ষস্থান দখল করেছিল ঢাকা। আর ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ যানজটপূর্ণ শহরের উপাধি রাজধানী ঢাকার দখলেই ছিল। গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষ ১০টি শহরের ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। ঢাকা শহর এর অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা কারণ হিসেবে বলেন, একটি শহরের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। তবে ঢাকায় সড়ক রয়েছে সর্বসাকল্যে মাত্র সাত থেকে আট শতাংশ। যদিও গাড়ি চলাচলের মতো যাতায়াতযোগ্য সড়ক রয়েছে মাত্র তিন থেকে চার শতাংশ।

যানজট ও বায়ুদূষণে ধ্বংসোন্মুখ পরিবেশ

বাংলাদেশের সড়ক ও যানজট পরিস্থিতির যখন এমন বেহাল হালচিত্র, তখন ঘরের চার দেয়ালেও যে স্বস্তি আছে, তাও নয়। সম্প্রতি এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত এক বছরে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যে কয়টি জরিপ হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেই ঢাকার অবস্থান ছিল তালিকার তলানিতে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত নিচে নেমেছে। সীমাহীন যানজট ছাড়াও কম বসবাসের যোগ্যতা ও বায়ুদূষণে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। গবেষকরা যানজটকেই এর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ‘ফন্ট্রিয়ারস ২০২২ : নয়েজ ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান ঢাকা শহরের শব্দের গড় তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল; যা বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বেশিরভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি; যা বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। গত ২২ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর জনস্বাস্থ্য শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে এখানকার শহরগুলোর বায়ু ৬ থেকে ২৫ গুণ মান খারাপ। ওই দূষিত শহরের মধ্যে অন্যতম শীর্ষে ঢাকা শহর। বাংলাদেশে যত অকালমৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। ধারাবাহিক শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, ক্যানসার, হৃদরোগ ও কোভিড ১৯-এর মতো রোগ বায়ুদূষণের কারণে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে যানজট ও পরিবেশ দূষণ রোধে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।

যানজটে বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি

আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন দ্রুত গতির যানবাহন আবিষ্কার সন্দেহাতীতভাবেই জীবনকে গতিশীল করলেও যানজট সেই গতিতে ফিরিয়ে এনেছে স্থবিরতা। দীর্ঘ যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ সময়। গত বছর রাজধানীর সড়কে পরিচালিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে এক কোটি ৯০ লাখ কর্মঘণ্টা। যানজটে নষ্ট হওয়া অতিরিক্ত সময়ের মূল্য গড়ে ঘণ্টায় ৭০ টাকা ধরে হিসেব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ ১৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে ঢাকার যানজট নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে যানজটে প্রতিদিন ৩৮ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি যথাসময়ে জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে পৌঁছাতে পারে না। উল্টো গন্তব্যে পৌঁছাতে তড়িঘড়ি করার কারণে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) ‘মিটিগেটিং ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা : অ্যাপ্রোপ্রিয়েট পলিটিক্যাল এজেন্ডা’ (ঢাকার যানজট কমানো : কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি) শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। গবেষকদের মতে, যদি রাজধানীর যানজট ৬০ শতাংশ কমানো যায়, তাহলে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তিন প্রকৌশলীর বর্ণনামতে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতি মাসে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ২২৭ কোটি টাকা। আর প্রতিবছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা।

যানজটে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

দীর্ঘ যানজটে সময় ও আর্থিক ক্ষতি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত ক্ষতি কম নয়। দীর্ঘক্ষণ যানজটে পড়ে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে ও উদ্বেগ বাড়ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুস ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ যানজটে পা গুটিয়ে গাড়ির মধ্যে বসে থাকায় হাঁটু, কোমর ও মেরুদণ্ডে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হচ্ছে ভুক্তভোগী মানুষের। সর্বক্ষণ গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকার ফলে নগরীর বায়ু দূষিত হচ্ছে। ফলে অ্যাজমা, হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শহরের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বলেন, রাজধানীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছেন রান্নাঘরের ধোঁয়ায়। এরপর যানজটে আটকা পড়ে মানুষ ধোঁয়াদূষণের শিকার হচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের শরীরে প্রতি মিটার কিউবে গড়ে ১০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত দূষণ সহনীয়। রাজধানীর বাসিন্দাদের গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম বায়ুদূষণ সহ্য করতে হচ্ছে। আর যানজটে আটকা পড়লে সেটি প্রতি মিটার কিউবে ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ডব্লিউএইচের বর্তমান গাইডলাইনের চেয়ে ঢাকা নগরবাসীকে ৬০ শতাংশের বেশি দূষণ সহ্য করতে হচ্ছে। এতে ফুসফুস ও প্রস্টেটগ্রন্থির ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে।

কানাডার সেন্টার ফর ড্রাগ অ্যাডিকশন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ (সিডিএএমএইচ) এক গবেষণা বলেছে, যানজটের মানসিক চাপ নিয়মিত গ্রহণ করলে মানসিক অস্থিরতা তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ। নিয়মিত যানজটের বিরক্তি থেকে মানুষের সংসার ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ।

বাংলাদেশ লাঙ ফাউন্ডেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলেন, ঢাকার যানজট বেশকিছু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। ট্রাফিক জ্যামের কারণে সৃষ্ট দূষণ ফুসফুসের অনেক ক্ষতি করে। যানবাহন যখন এক জায়গায় অনেক সময় ধরে আটকে থাকে, তখন দূষিত ধোঁয়া ওই জায়গাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। কারণ, আমরা যানজটে গাড়ির ইঞ্জিন চালু রাখি। আপনার নিজের গাড়ি এবং আপনার আশপাশের সবার গাড়ির ধোঁয়া তখন আপনার কাছে আসছে। গাড়ি চলমান অবস্থায় ধোঁয়া বাতাসে উড়ে যায়। এ জন্য ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকাকালীন একজন মানুষ দূষণে বেশি এক্সপোজড হচ্ছেন। দূষণের কারণে ফুসফুসের অসুখসহ নানা সমস্যা হচ্ছে।

ড. বেননুর আরও বলেন, উচ্চমাত্রায় সিসা মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে। বহুদিন সিসাযুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে আসে। কিডনি, হৃদযন্ত্র, প্রজননতন্ত্রের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তিনি বলেন, ঢাকার চারপাশে চারটি বড় নদী থাকলেও যানজট নিরসনে সেগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। দূষণের সম্মিলিত নেতিবাচক প্রভাবে ঢাকা শহর একটি অসুস্থ নগরে পরিণত হচ্ছে। সুস্থ জাতি গঠনে এখন যানজট, শব্দণ্ডবায়ু-পানি দূষণ রোধে সবাই মিলে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত