পৃথিবীর যত প্রাণঘাতী উদ্ভিদ

পৃথিবীতে মোট ৩ লাখ ৯০ হাজার ৯০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এদের বেশিরভাগই মানুষের জন্য উপকারী। যেগুলো প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবে মানুষ যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। তবে সব সময় যে গাছপালা আমাদের উপকার করবে, এমনটি নয়। উদ্ভিদের কিছু প্রজাতি রয়েছে, যেগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নিতে সক্ষম। এমনকি অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল সংবলিত এবং মিষ্টি ফলের গাছও রয়েছে, যেগুলোকে প্রথম দেখায় কেউই ভাববে না- এসব বিষাক্ত। এ ধরনের গাছ এবং গাছের ফুল, ফল, মূল ইত্যাদি থেকেই তৈরি হয় পৃথিবীর যত প্রাণঘাতী বিষ। বিশ্বের এমন কিছু প্রাণঘাতী উদ্ভিদ সম্পর্কে জানাচ্ছেন- মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তামাক

আমরা সবাই জানি তামাকের ক্ষতিকর দিকের কথা। তামাকই হলো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জন্মানো উদ্ভিদ; যা মূলত কোনো খাবারের শ্রেণিতে পড়ে না। উদ্ভিদটির প্রায় সবখানেই, বিশেষ করে এটির পাতায় রয়েছে বিষাক্ত অ্যালকালয়েডস নিকোটিন এবং অ্যানাবেসিন, যা সরাসরি গ্রহণ করলে পরিণাম হবে মারাত্মক। যদিও একে হৃদপিণ্ডের জন্য একটি বিষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবুও তামাকের নিকোটিনকে বিশ্বব্যাপী চিত্তপ্রভাবকারী, আসক্তিকর এবং নেশাকর হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

অলিন্ডার

অলিন্ডার দেখতে অত্যন্ত চমৎকার একটি উদ্ভিদ। এটির প্রধান আকর্ষণ এর ফুলগুলো। বিভিন্ন প্রতিষেধক এবং অলংকার হিসেবে ব্যবহার করা হলেও অলিন্ডার উদ্ভিদের আগাগোড়া বিষাক্ত। কারণ, এতে রয়েছে অলেন্ড্রিন এবং নেরিয়াইন নামক বিষাক্ত কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড। অলিন্ডারের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Nerium Oleander। কোনোভাবে এটি খাওয়া হলে তা বমি, ডায়রিয়া, অস্থির নাড়ির স্পন্দন, সিজার, কোমা এবং মৃত্যু ঘটায়। উদ্ভিদটির পাতা এবং রসের সংস্পর্শে এলেও শরীর জ্বালাপোড়া করে। এমনকি অনেক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শুধু মৌমাছিজাত মধু পান করে। যে মৌমাছিগুলো ঘটনাক্রমে এ অলিন্ডার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেছিল। তবে অলিন্ডার বিষ থেকে মৃত্যুর ঘটনা খুব কম। কারণ, উদ্ভিদটি বেশ তিক্ত। তাই কেউ ভুলেও উদ্ভিদটি শাক-সবজি ভেবে ব্যবহার করেন না।

রোজারি পি

রোজারি পি আরেকটি নামেও বেশ পরিচিত, জেকুইরিটি বিনস। বাংলাদেশেও এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- রতি, রত্তি, গুঞ্জা, চূড়ামণি, কুঁচ, কইচ গোটা ইত্যাদি। নামের দিক দিয়ে বেশ রাজকীয় এবং নিরীহ মনে হলেও এ উদ্ভিদে রয়েছে বিষাক্ত এব্রিন; যা রাইবোজোম দমন করে থাকে। রোজারি পিকে মূলত দেখতে পাওয়া যায় গ্রীষ্মপ্রধান এলাকাগুলোতে। মাঝে মাঝে এটিকে বিভিন্ন অলংকার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রোজারি পির বৈজ্ঞানিক নাম হলো Abrus precarious। এটির বীজ অক্ষত থাকাবস্থায় মোটেও ক্ষতিকর নয়। কিন্তু যখনই বীজটি ভাঙা হয় বা ফেটে যায় এবং চিবানো হয়, তখনই এটি হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী বিষ। মাত্র ৩ মাইক্রোগ্রাম এব্রিনই যথেষ্ট একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলতে। আর একটি রোজারি পির বীজে ৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি এব্রিন থাকে। প্রচলিত আছে, অনেক অলংকার নির্মাতা এ বীজটি নিয়ে কাজ করার সময় ঘটনাক্রমে আঙুলে খোঁচা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন; অনেকে মারাও গেছেন। রাইসিনের মতো এব্রিনও রক্তে আমিষের সঞ্চালনে বাধা প্রদান করে। মাত্র চার দিনে যে কোনো অঙ্গ নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে।

ক্যাস্টর বিন

শোভাবর্ধক হিসেবে বেশ পরিচিত ক্যাস্টর বিন হলো আফ্রিকার অন্যতম আকর্ষণীয় উদ্ভিদ। তবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এটি দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে উদ্ভিদটি রেড়িগাছ, ভেন্নান গাছ নামে পরিচিত। ক্যাস্টর অয়েল একটি সাধারণ পদার্থ; যা সাবান থেকে রঙে, কালি এবং এমনকি সুগন্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত পণ্যগুলিতে ব্যবহৃত হয়। ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহৃত এক রেচক হিসেবেও পরিচিত। ক্যাস্টর শিমের মধ্যে রিকারিন রয়েছে। এটি অত্যন্ত বিষাক্ত জ্ঞানযুক্ত উপাদান। এমনকি একক ক্যাস্টর শিম চিবানো অসুবিধার লক্ষণগুলো নিয়ে আসে, যা হাসপাতালে প্রেরণ করে এবং চার বা ততোধিক বীজ গ্রহণের ফলে মারাত্মক গ্যাস্ট্রো এন্টেরাইটিস হতে পারে। উদ্ভিদটি মূলত আফ্রিকার স্থানীয়। তবে এটির সৌন্দর্য এবং দরকারিতার কারণে (ডান প্রক্রিয়াকরণসহ) এটি বিশ্বজুড়ে চাষাবাদ করা হয়েছে।

সাদা স্নেকরুট

এ উদ্ভিদটিকে দেখতে পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়। এতে বেশ সুন্দর সাদা ফুল হয়। কিন্তু এ ফুলগুলোতেই থাকে এক ধরনের বিষাক্ত অ্যালকোহল; যার নাম ট্রিমাটল। দেখতে বেশ নিরীহ প্রজাতির এ স্নেকরুট উদ্ভিদটিই আব্রাহাম লিংকনের মা ন্যান্সি হ্যাংকসের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে তিনি অন্যদের মতো সরাসরি উদ্ভিদটির ফুল খাওয়ার ফলে মারা যাননি। তিনি শুধু একটি গাভির দুধ পান করেছিলেন। যে গাভিটি ঘটনাক্রমে এ স্নেকরুট উদ্ভিদটি খেয়েছিল। ফলে এটির দুধও বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। উদ্ভিদটি এতটাই বিষাক্ত যে, এটি যে প্রাণী খাবে, তার মাংসও বিষাক্ত হয়ে পড়বে। স্নেকরুটের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Ageratina altissima। এই মারাত্মক উদ্ভিদ খাওয়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রথমে ক্ষুধামান্দ্য হয়। তারপর বমি বমি ভাব, শারীরিক দুর্বলতা, উদরীরোগ, জিভ লাল হয়ে যাওয়া, রক্তে এসিডিটি এবং সবশেষে মৃত্যু হয়। তবে বর্তমানে কৃষকদের এ উদ্ভিদ সম্পর্কে সচেতন করে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বেশ সতর্কতার সঙ্গে তাদের পালিত পশুদের বনে চারণ করছেন।

প্রাণঘাতী নাইটশেড

একটি কিংবদন্তি থেকে পাওয়া যায়, ম্যাকবেথের সৈন্য দল ডেনসের আক্রমণকারী সৈন্যদের একটি মিষ্টি ফল থেকে তৈরি ওয়াইন খাইয়ে হত্যা করেছিল। সেই মিষ্টি ফলের উদ্ভিদটিই হলো এ প্রাণঘাতী নাইটশেড। এ উদ্ভিদটিতে রয়েছে ছোট ছোট জামের মতো দেখতে মিষ্টি ফল; যা বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়দেরও আকৃষ্ট করে। দক্ষিণ ও মধ্য ইউরেশিয়ার বন এবং পরিত্যক্ত এলাকায় এই ধূসর সবুজ রঙের পাতা এবং ঝকমকে জামজাতীয় ফল-সম্বলিত গাছটির দেখা পাওয়া যায়। এ উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম হলো Atropa belladonna। নাইটশেডের কাণ্ড, পাতা, ফল এবং মূলে রয়েছে এট্রোপিন ও স্কোপোলামাইন; যা দেহের অনৈচ্ছিক পেশি (যেমন হৃৎপিণ্ডতে) পক্ষাঘাতের সৃষ্টি করে। এমনকি শুধু এ উদ্ভিদটিকে স্পর্শ করলে বা দেহের কোনো অংশ উদ্ভিদটির সংস্পর্শে এলে শরীরে জ্বালাতন করে।

আবরাস প্রাক্টরিয়াস

মনোরম এ ছোট্ট উদ্ভিদটি মূলত ভারত এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে জপমালা হিসেবে বা বাদ্যযন্ত্রের জন্য ব্যবহৃত হতো। আকর্ষণীয় চেহারা এবং দরকারিতার কারণে ফ্লোরিডাসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এটি চালু হয়েছিল। এটি দ্রুত আগাছা হয়ে উঠতে পারে। যদিও এটি নিজের মধ্যেই বিরক্তিকর। কারণ, বীজগুলো সম্ভাব্য মারাত্মক। এগুলো আবর্ন নামে পরিচিত। এতে অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে; যা ইনসুলিন, রিকিন, বোটুলিনাম, কলেরা এবং ডিপথেরিয়া বিষের সঙ্গে একই রকম। বীজের শক্ত খোলটিতে সাধারণত বেশিরভাগ টক্সিন থাকে। যারা এটিকে হালকাভাবে পরিচালনা করেন, তাদের ওপর এটির প্রভাব তৈরি করে। তবে শেলটি খোলা বা পিষ্ট হলে প্রভাবগুলো বিপর্যয়কর। পুরোপুরি চিবানো এবং গিলে ফেলা একটি একক বীজ শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মারাত্মক। আসলে এটি আত্মহত্যার চেষ্টায় প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অনেক ব্যবহারের কারণে এ উদ্ভিদটি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক উদ্ভিদের তালিকার শীর্ষে। এখনও এটি মূল্যবান বলে বিবেচিত। এ গাছের বীজের প্রশংসা করা গেলেও ভুলেও এর ফসল কাটা যাবে না।

ম্যানচিনেলা ট্রি

এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিষাক্ত গাছ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ, এ গাছ থেকে এক প্রকার বিষাক্ত রস নিঃসরিত হয়। এর বিস্তার ট্রপিক্যাল নর্থ এবং সাউথ আমেরিকায়। তবে খুব বেশি দেখা যায় ফ্লোরিডা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে। এটি দেখতে খুবই সুন্দর ও আকর্ষণীয়। দেখেই মনে হতে পারে, রূপ দেখতে এত সুন্দর! সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এ গাছের নিচে জিরানো যায়। সাধারণত কোনো গাছের নিচে বসলে মনের অজান্তেই পাতা ছিঁড়ি। কিন্তু সেখানেই শুরু হয় মহাবিপদ। কারণ, পাতা স্পর্শ করার সঙ্গেই হাতে ডার্মাটাইটিস এর প্রদাহ শুরু হবে। এমনিতে কষ নিঃসৃত হয়, আর তখন যদি গাছ স্পর্শ করা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে ফোসকা পড়ে যায়। চোখে গেলে অন্ধ হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির সময় এ গাছের চিচে একদমই দাঁড়ানো যাবে না। এ জন্য এ গাছকে Tree of Death বলা হয়। এর ফলগুলো দেখতে অনেকটা ম্যানগ্রোভ অয়াপলের মতো। এটিকে ডেথ অ্যাপল বা বিচ অ্যাপলও বলা হয়। এ ফল খেলে ঠোঁট থেকে শুরু করে পেটের নাড়িভুড়ি-পাকস্থলী সবই জ্বলতে থাকে। এ জন্য গাছটি deadliest tree হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে জায়গা করে নিয়েছে।

সুইসাইড ট্রি

প্রাকৃতিকভাবেই এটি ভারতে জন্মায়। বিশেষ করে, উপকূলীয় লবণাক্ত জলাভূমিতে দেখা যায়। পাতাগুলো দেখতে যেমন সাজানো, ফুলও খুবই সুন্দর আকর্ষণীয়। সহজেই ভালোবেসে ফেলার মতো। এ গাছের সারা গায়ে বিষাক্ত হুল রয়েছে। যেখানে কার্ডেনোলাইড এবং কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড নামক বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যায়। যা আমাদের হৃদপেশীর কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। মানুষের গায়ে একবার যদি লাগে, প্রায় দু’বছর পর্যন্ত যন্ত্রণা হতে পারে।

স্ট্রেচনিই ট্রি

এটিও প্রাকৃতিকভাবে ভারতে জন্মায়। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও দেখা যায়। দেখতে বেশ লাগে। এ গাছের পাতা, বাকল ও ফলে স্ট্রিকনিন ও বুসিন নামক বিষাক্ত টক্সিন রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এর ফল মারাত্মকভাবে বিষাক্ত। এর বিষ আমাদের স্নায়ুকার্য বন্ধ করে দেয়। ফলে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, দুর্বলতা ও ধনুষ্টংকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।