যানজট নিরসনে ইসলাম
মিনহাজুল আরিফীন
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তির জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা সর্বক্ষেত্রেই সুন্দর একটি জীবন নিশ্চিত করতে পারে। প্রয়োজন শুধু ধর্মীয় মূল্যবোধ লালন, ধারণ ও পালন করা। যানজট নিরসনে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্রুত বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নাগরিক সজাগ ও সচেতন হলে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারলে এ সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ জরুরি। যেমন-
দায়িত্ব সচেতন হওয়া
দেশের প্রতিটি নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হলে সমাজ জীবনের শৃঙ্খলা অনেক অটুট ও সুন্দর হবে। প্রায়ই দেখা যায়, অনেকেই রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে রাখে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ফুটপাতগুলো দখল করে রাখে। এতে মূল রাস্তায় চাপ বেশি পড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যানজটের আরেকটি বড় কারণ হলো যত্রতত্র বাস স্টপেজ। গণপরিবহণগুলোর জন্য রাজধানীতে কোনো সুনির্দিষ্ট ও নির্ধারিত বাস স্টপেজ নেই। এতে করে একের পর এক গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে অন্য গাড়ির চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে যানজট তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে কোনো রকম নিয়মনীতি বা আইনের তোয়াক্কা না করেই যত্রতত্র দালান-কোঠা, কলকারখানা গড়ে তুলছে কিছু দায়িত্ব-কর্তব?্যহীন মানুষ। সবার মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকলে কখনও এমনটা হতো না। ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি : ৮৫৩, মুসলিম : ৪৮২৮)।
অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া
অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার মানসিকতা যানজট অনেকাংশে কমিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে। বন্ধ হতে পারে অযথা ওভারটেকিং। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, ড্রাইভারদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, আগে যাওয়ার প্রবণতা যানজট বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার ৯৮ দশমিক ৩ ভাগ গণপরিবহন এবং ৬৮ ভাগ প্রাইভেটকার ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। অথচ একে অন্যের প্রতি সহনশীল ও কল্যাণকামী হলে এবং অন্যকে অগ্রাধিকার দিলে সবার জন?্যই পথচলা সহজ হয়। এটিই ইসলামের শিক্ষা। হাদিসে এসেছে, ‘দ্বীন মানেই হলো নসিহত বা কল্যাণকামিতা।’ (মুসলিম : ২০৫)। অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রসঙ্গে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা তাদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রসস্ত হলেও।’ (সুরা হাশর : ৯)।
রাস্তা সচল ও পরিষ্কার রাখা
শহরের যত্রতত্র অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যানজট ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম অনুষঙ্গ। অথচ রাস্তা সচল ও পরিষ্কার রাখা ঈমানের অংশ। কাজেই রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী রাখা বা ময়লা-আবর্জনা ফেলা ঈমানের দাবি নয়; বরং ঈমানের দাবি হলো, রাস্তা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখা, কোনোভাবেই রাস্তা বন্ধ না করা। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরের বেশি শাখা রয়েছে। সর্বোত্তম শাখা হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা। আর সর্বনিম্ন শাখা হলো, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা।’ (মুসলিম : ১৬২)।
বিলাসিতা পরিহার করা
একটি জরিপের হিসাব অনুযায়ী ১৮ লাখের বেশি যানবাহন চালাচ্ছেন ভুয়া চালকরা। যানজট কিছুমাত্র কমাতে চাইলে এই গোড়ার সমস্যাটিই সবকিছুর আগে সমাধান করতে হবে। প্রথমে নির্ধারণ করতে হবে ঢাকা মহানগরে মোট কতসংখ্যক যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেয়া হবে, পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন সরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজনে নতুন নিবন্ধনের সংখ্যা নির্ধারিত হবে। যানবাহন ও লোকসংখ্যার তুলনায় রাস্তাঘাট বাড়ছে না। বিপরীতে অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে রাস্তাঘাট আরও কমছে। অত্যধিক জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপ অপর্যাপ্ত রাস্তা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। অপচয় ও অযথা ব্যয় করা অবাঞ্ছিত আচরণ। অপচয় ও অযথা ব্যয় থেকে বিলাসিতা তৈরি হয়। তখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অথবা অপ্রয়োজনে গাড়ি কেনা হয়। গাড়ির আধিক্যের কারণেও যানজট সৃষ্টি হয়। গাড়ি ক্রয় ও ব্যবহারে অপচয় ও অযথা ব্যয় পরিহার করে যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)।
উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ নিশ্চিত করা
অনেক সময় রাস্তাঘাট নির্মাণে সরকারি বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার হয় না। নির্মাণকাজে তুলনামূলক কমদামি সামগ্রী ব্যবহার করার ফলে রাস্তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আবার মেরামত করতে রাস্তা বন্ধ করতে হয়। মেরামত না হলে ভাঙা পথ পাড়ি দিতে অনেক সময় নষ্ট হয়। এসব কারণেও যানজট সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দের যথার্থ ব্যবহার করা হলে রাস্তাঘাট সুন্দরভাবে নির্মিত হতো। সুন্দর চলাচলব্যবস্থার সুযোগ হলে যানজট অনেকাংশে কমে যেত। সরকারি বরাদ্দের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ইউসুফ (আ.) বলেছিলেন, ‘আমাকে দেশের ধনভান্ডারের ওপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও সুবিজ্ঞ।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৫)। রজস্ব ফান্ড সব জনগণের অধিকার। আর অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করাকে ইসলাম চরম ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করবে না। মানুষের সম্পদের কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে দখল করার উদ্দেশ্যে আদালতে মামলা দায়ের করবে না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। মনে রাখতে হবে, অন্যায়ভাবে টাকা আত্মসাৎ করে বাড়ি নির্মাণ করার প্রতিটি ইট, বালুকণা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। রাসুল (সা.) সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘হে লোকেরা! তোমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সরকারি কোনো পদে নিয়োগ করার পর সে যদি আমাদের তহবিল থেকে একটি সুই কিংবা তার বেশি আত্মসাৎ করে, তবে সে খেয়ানতকারী। কেয়ামতের দিন সে তার এ খেয়ানতের বোঝা নিয়ে উপস্থিত হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৫৮১)।
ঘুষ লেনদেন বন্ধ করা
শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে হরহামেশা পরিলক্ষিত হয় অসাধু ট্রাফিক পুলিশের দৌরাত্ম্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। ট্রাফিক পুলিশের সেবা নিতে গিয়ে ঘুষের শিকার হয়েছে ৮৫.৬ শতাংশ। এর পরের অবস্থান হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশের। অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু দেয়া ও নেয়াকে ঘুষ বলে। দুটোই অভিসম্পাতযোগ্য অপরাধ। ঘুষ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধি। ঘুষের আদান-প্রদান তথা লেনদেন একটি নিকৃষ্টতম পন্থা। সমাজে ঘুষের প্রচলন মানুষের নীতি-নৈতিকতা নষ্ট করে দেয়। ঘুষের কারণেই সমাজে সব অবৈধ ও অনৈতিক কাজের সুযোগ তৈরি করে। ফলে মানুষের আস্থা-বিশ্বাস উঠে যায়। এক পর্যায়ে এর জের ধরে নানা রকম হানাহানির সৃষ্টি হয়। তাই এ নিকৃষ্ট পন্থা থেকে বিরত থাকা ইসলামের নির্দেশ। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে আয়-উপার্জন করাকে নিষেধ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৫৮০, তিরমিজি : ১৩৩৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি।’ (মুজামুল আওসাত : ২০২৬)।