প্রকৃতির সৌন্দর্য অপছন্দ– এমন ব্যক্তি পাওয়া বেজায় মুশকিল। কে-ই বা কোমল না হয় প্রকৃতির সবুজ রং দেখে! সবুজ শ্যামল ভূমি মনের প্রশান্তি আনতে বড় ভূমিকা পালন করে। শহুরে মানুষগুলো গ্রামে ছুটে আসতে চায় সবুজের চাদরে আবৃত প্রকৃতি দেখতে, সস্তির শ্বাস ফেলতে। চোখ জুড়িয়ে যায় এর সৌন্দর্যে। সবুজ শ্যামলের জন্যই কিন্তু বিলাসবহুল লোকদেরও এ আকর্ষণ। কথায় আছে, দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে! ইট-পাথরে সজ্জিত দালানকোঠা কি আর প্রকৃতির সবুজে রূপের ধারেকাছে আসতে পারে! কৃত্রিম সৌন্দর্যের প্রশস্ততা, জাকজমকতা যতই হোক না কেন মানব হৃদয়ে তা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ন্যায় আপন হতে পারে না। কৃত্রিম আসবাবগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকে কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ। কিন্তু প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্যে চোখের শীতলতার মধ্যেই শেষ নয়, রয়েছে মানবদেহের সুস্থতার মূল্যবান উপকরণও।
নন্দিত প্রকৃতি দেখতে প্রায়ই ভিড় করা হয় পাহাড়-পর্বত, গাছপালায় ভরা অঞ্চলগুলোতে। কত অর্থ খরচ করা হচ্ছে, দূরের পথ পাড়ি দেয়া হচ্ছে শুধু বনভূমির সৌন্দর্য উপভোগে। কেনই বা এতে স্থির হবে না কোনো চোখ কিংবা আকুল হবে না কোনো অন্তর! কারণ, প্রকৃতির মাঝে রয়েছে হরেক রকমের তৃপ্তি। একেক স্থানের রূপ একেক রকম। আলাদা আলাদা গাছের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ফুল, ফল। মন চায় এসবকে সঙ্গী করে রাখা হোক সব সময়ের জন্য। তাই হয়তো অনেকে টবে করে বিভিন্ন গাছের সৌন্দর্য মাধুর্যময় করে বাড়ির আঙিনা, আড্ডার আসর। এমনকি এ সৌন্দর্য যেন অক্ষয় থাকে, সেজন্য দেশের দায়িত্ববানদের তত্ত্বাবধানে সাজানো হয় জায়গায় জায়গায় সড়কদ্বীপ। লাগানো হয় উপকারী বাতাস প্রদানকারী গাছসহ নানাজাতের ফুলগাছ। নিয়ম করে পরিচর্যার জন্য অনেক জায়গায় নির্দিষ্ট কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। যেন পথচারীর এ সৌন্দর্যও উপকার-উপভোগে কমতি না হয়। হচ্ছেও এমনটা।
দীর্ঘ বাহনপথে অনেকে এসব দেখতে দেখতেই ভুলে যাচ্ছে যাত্রাপথের ক্লান্তি। পথিক হাঁটার সময় মন ভরে দেখছে এ আবেদনময়ী কায়া। সড়কদ্বীপগুলো যেন হয়ে উঠেছে আমাদের পরম বন্ধু। শহুরে বন্ধুর মতো গ্রামীণ সড়কদ্বীপের অবহেলিত গাছগুলোও প্রতিনিয়ত উপহার দিচ্ছে এমনসব আনন্দণ্ডউল্লাস। পথচারী ভোগ করছে সতেজ বাতাস। বাহনে গমনকারী যাত্রী অবলোকন করছে এর সৌন্দর্য। আর পরিবেশের দূষণ নিজে গিলে নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের ভেজালহীন অক্সিজেন দিচ্ছে, সে কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গে গালিচার মতো সবুজে রাঙা ঘাসগুলো সড়কের মাটিকে যেভাবে দেশপ্রেমিক সৈনিকের মতো রক্ষা করছে, সে উপকারই বা পরিচর্যাহীন সড়কদ্বীপের এসব সৈনিকদের থেকে কম কী! কিন্তু সড়কদ্বীপের এ সৈনিক, নান্দনিক গাছগুলোর প্রতি কিছু কর্ম বড় মর্মান্তিক।
ফুলে, গাছে সাজানো সড়কদ্বীপগুলোর উপকার ভোগ করা হয় ঠিকই; কিন্তু আচরণ করা হচ্ছে এদের সঙ্গে স্বার্থপরের মতো। প্রথমত শহুরে সড়কদ্বীপের কথাই বলি, আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, অকারণে সৌন্দর্য বর্ধিত গাছগুলোর গা ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে তার অস্তিত্ব আলাদা করে। গ্রামীণ সড়কদ্বীপগুলো তো এমনিতেই পরিচর্যাহীন। অবশ্য এগুলো আপন গতিতেই বাড়তে পছন্দ করে। কিন্তু গবাদি পশুর আহার জোগাতে মাঠের পরিবর্তে সড়কদ্বীপের ঘাসকুটো ব্যবহার করে সড়কের মাটি রক্ষা করা সৈনিকদের বাহুবল কমজোর করে দেয়া হচ্ছে।
সিনথেটিক আবর্জনা থেকে তো রক্ষা পাচ্ছে না শহুরে, গ্রামীণ কোনো সড়কদ্বীপই; দিনশেষে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের ও আমাদের। গাছপালাগুলো নিজ গতি হারিয়ে ফেলছে, সঙ্গে হারাতে হচ্ছে সার্বক্ষণিক গ্রহণ করা সতেজ বাতাস। ক্ষতি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ সৈনিক সন্তানদের, আমাদের পরিবারের আর ক্ষতি হচ্ছে পরম বন্ধু সড়কদ্বীপের। ভেবে দেখা উচিত, উপকারীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম কি এমন হওয়া খুব জরুরি! জন কয়েকের অসৎ আচরণে সড়কদ্বীপের কাছে দোষী হতে হচ্ছে গোটা সমাজের মানুষকে। আমি না হয় পরিচর্যা করে উপকার করতে না পারলাম, অন্তত সড়কদ্বীপের গাছগুলোর সৌন্দর্য নষ্ট থেকে বিরত থাকি। একটু অভ্যাস করি অন্যের উপকার করার, পরিবেশকে সুন্দর করার। এসবের জন্য ভূরি ভূরি অর্থ বা কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। স্রেফ দরকার মনের পরিবর্তন। আমাদের সচেতন হতে হবে। ওদের প্রতি যত্নবান হতে হবে।
পরিবেশকে সুন্দর রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। ভালোবাসার ছোঁয়া ব্যাপক করে দিতে হবে সবার ওপর। পরম মমতায় আগলে রাখতে হবে এসব অবহেলিত প্রাকৃতিক বন্ধুদের। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহতায়ালা তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।’ (সুরা লোকমান : ২০)।