মানুষ যেন নিজের অপরাধের জন্য তওবা করে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে, নিজের অনৈতিক আচার-আচরণ ঠিক করে নেয়, সবার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে, আল্লাহকে অনেক বেশি স্মরণ করে এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সেজন্য ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এককথায়- ভূমিকম্প মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। মানুষকে সতর্ক করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার আজাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে!’ (সুরা আরাফ : ৯৭)। বান্দার অপরাধ ক্ষমা প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিপদাপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শূরা : ৩০)।
অবাধ্যদের জন্য সতর্কতা
অতীতে আল্লাহতায়ালা অবাধ্যতার সাজা হিসেবে ভূমিকম্প দিয়ে কয়েকটি জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন। সালেহ (আ.)-এর জাতি সামুদ, শোয়াইব (আ.)-এর জাতি মাদইয়ানবাসী ও লুত (আ.)-এর জাতি কওমে লুতকে ভূমিকম্পের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের কাউকে আমি মাটির নিচে গেড়ে দিয়েছি।’ (সুরা আনকাবুত : ৪০)। তবে মহানবী (সা.)-এর বিশেষ দোয়ার কারণে আল্লাহতায়ালা তার উম্মতকে পুরোপুরি ধ্বংস না করার অঙ্গীকার করেছেন। অবশ্য মাঝেমধ্যে তাদের সতর্ক করার জন্য ভূমিকম্পের মতো ধ্বংসাত্মক দুর্যোগ পাঠিয়ে থাকেন।
ভূমিকম্পের বিশেষ কারণ
হাদিসের মাধ্যমে ভূমিকম্পের কতগুলো কারণ সম্পর্কে জানা যায়। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে; কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখলে তা আত্মসাৎ করা হবে; জাকাতকে মনে করা হবে জরিমানা হিসেবে; ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে; পুরুষ তার স্ত্রীর বাধ্যগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে; বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে বাবাকে দূরে সরিয়ে দেবে; মসজিদে শোরগোল (কথাবার্তা) হবে; সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি সমাজের শাসক হবে; সে সময় তোমরা অপেক্ষা কর রক্তিম বর্ণের ঝড়ের, ভূকম্পনের, ভূমিধসের, লিঙ্গ পরিবর্তন ও পাথর বৃষ্টির এবং সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ)
দানার ন্যায় একটার পর একটা নিদর্শনের।’ (তিরমিজি : ১৪৪৭)।
ভূমিকম্প কেয়ামতের নিদর্শন
ভূমিকম্প কেয়ামতের দিনের ভয়াবহতার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনে ভূমিকম্প বিষয়ে ‘যিলযাল’ এবং ‘দাক্কা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘যিলযাল’ অর্থ- একটি বস্তুর নড়াচড়ায় আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা। ‘দাক্কা’ অর্থ- প্রচণ্ড কোনো শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোনো কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া। ভূমিকম্প সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘এ উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণের মুখোমুখি হবে।’ একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন সেটা হবে হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে এবং মদ্যপানের সয়লাব ঘটবে।’ (তিরমিজি : ২২১২)।
বিভীষিকা সম্পর্কে সতর্কতা
ভূমিকম্পের বিভীষিকা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামত দিবসের ভূকম্পন হবে মারাত্মক ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, স্তন্যপায়ী মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কথা ভুলে যাবে; আর সব গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে। আসলে তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।’ (সুরা হজ : ১-২)।
ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ কখনও কখনও পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। এটা মানুষকে ভীত করে। ফলে তারা মহান আল্লাহর কাছে তওবা করে। পাপকাজ ছেড়ে দেয়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের কৃত পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়।’ কেয়ামত যত নিকটবর্তী হবে, ভূমিকম্পের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম (জ্ঞান) তুলে নেয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফেতনা প্রকাশ পাবে, খুন-খারাবি বৃদ্ধি পাবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, তা উপচে পড়বে।’ (বোখারি : ১০৩৬)।
আল্লাহর পাঠানো সতর্কবার্তা
বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, তা মহান আল্লাহর পাঠানো সতর্কবার্তার নিদর্শন। এগুলো দিয়ে তিনি বান্দাদের সাবধান করেন। মূলত এগুলো মানুষের পাপ ও অপরাধের ফল। ভূমিকম্প এমনই এক দুর্যোগ; যা নিবারণ, প্রতিকার বা প্রতিরোধ করা বা পূর্বাভাষ পাওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি মানুষ এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। সুতরাং ভূমিকম্পের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ভূকম্পনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে সতর্ক করেন; যাতে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত, কেন এত ভূমিকম্প হচ্ছে?
দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন সৃষ্টি করেন। বান্দাদের উচিত, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া; যাতে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাদের বোধোদয় হয়।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৫৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘বলে দাও! আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’ (সুরা আনআম : ৬৫)। শায়খ রাগেব ইস্পাহানি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ভূমিকম্প ও ভূমিধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া (পৃথিবীতে ভূমিকম্প হওয়া)।’ (আল মুফরাদাত ফি গরিবিল কোরআন)।