সড়কের নীতিহীনতা পরিহার করুন
ফারুক হাসান
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সংক্ষেপে মানব সমাজের পরিচয় দিতে গেলে বলা যায়, একাধিক মানুষের বসবাসের উপযোগী স্থানকে সমাজ বলে। সমাজ গঠনের পর জনগণের সবচেয়ে বড় করণীয় হচ্ছে তা সুন্দর, সুশৃঙ্খল রাখা। সমাজকে সুন্দর রাখতে বসবাসকারীদেরই সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। এমনকি সমাজে জনগণের চালচলন, নিয়মকানুনে বিবেচিত হয় সে সমাজ সভ্য নাকি অসভ্য! সভ্য সমাজের মানুষের আচরণ থাকে একে অন্যের প্রতি উপকারীর মতো। একজন অপরজনের বিপদে এগিয়ে আসবে, সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখবে, এটাই সুশীল সমাজের দাবি। সমাজের নির্ধারিত নিয়ম মান্যকারীকে সামাজিক ব্যক্তি বলেই আখ্যা দেয়া যায় এবং তা সম্মানেরও। তাই আমাদের সমাজকেও সুন্দরকরণে প্রয়োজন সচেতনতা ও নিজ দায়িত্ববোধে সোচ্চার হওয়া। সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে প্রত্যেক স্থানে; ঘরে-বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায়। এমনকি ব্যস্ততার তাগিদে ব্যবহার করা সড়কেও আমাদের সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে হরদম।
যত্রতত্র ক্ষতিকর গাড়ির হর্ন
সড়কপথের কিছু অসংগতি এমন রয়েছে, যা সমাজে বসবাসকারী লোকদের জন্য বড় কষ্টের কারণ। তা বর্জন করা একান্ত আবশ্যক। এর একটি হলো, যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানো। অন্য প্রায় সবকিছুতে পছন্দণ্ডঅপছন্দের দ্বন্দ্ব থাকলেও অতিমাত্রায় আওয়াজ অপছন্দে কোনো মতপার্থক্য নেই। অতিরিক্ত আওয়াজ শুধু অপছন্দই নয়, অসহনীয়ও বটে। বিকট আওয়াজ স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। ক্ষতিকর আওয়াজের মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে গাড়ির হর্ন। এ আওয়াজটা এতটাই ভায়াবহ ক্ষতি; যা বলার অপেক্ষা রাখে না। পথচারী কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থেকেও বর্তমানে এ আওয়াজ থেকে রেহাই পাওয়া বড় মুশকিল। রাস্তা থেকেই এর শব্দ পৌঁছে যায় অনেক দূরে। এর মধ্যে এ হর্ন যদি গর্জে ওঠে স্কুল-কলেজ, হসাপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এসে অথবা জ্যামে আটকে থাকা অবস্থায় পাশের গাড়ি থেকে, তাহলে অবস্থানরত শিক্ষার্থী, রোগী ও অন্যদের অবস্থা কেমন হবে! ক্ষতিকর আওয়াজ যেমন মনোযোগ নষ্ট করে, তেমনি স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিদরা বলেন, বর্তমান সময়ে গাড়িতে ব্যবহৃত শব্দের মাত্রা মানুষের সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণের বেশি, যা মানুষের জীবন ঝুঁকির বড় কারণ। হুটহাট এমন বিকট শব্দে মনে যেমন ভয় সৃষ্টি হয়, তেমনি হৃৎপি-ে বড় ধরনের আঘাত হানে। ফলে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হওয়া ও নানান মানসিক সমস্যা তৈরির সম্ভাবনা প্রবল। এমনকি অতিমাত্রায় আওয়াজ মানুষকে বধির করে ও শিশুর মেধা বিকাশের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। এসব ক্ষতি সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত। কিন্তু সচেতন হাতেগোনা কয়েকজন। এ ছাড়া হর্ন বাজাতে দেখাতে যাচ্ছে যেখানে-সেখানে অকারণে। কোথায় বিদ্যালয়, হাসপাতাল, তার কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। অনেকে হর্ন বাজানোতে নিত্যানন্দের স্বাদ পায় যেন। এসব অযাচিত বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে বহু কলাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে নানা সময়ে নানা বিজ্ঞাপন। এমনকি ২০১৮ সালে আদালতের এক আইনে ঘোষণা করা হয়, অতিমাত্রায় ক্ষতিকর আওয়াজ উৎপাদনকারী হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ। মানুষের সহনীয় এমন হর্ন ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় গুনতে হবে নির্ধারিত জরিমানা কিংবা ভোগ করা লাগতে পারে জেলহাজতের শাস্তি। পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে তদারকি করেছে, অনিয়মকারীদের জরিমানাও করেছে। তবে তেমন পরিবর্তন হয়নি। ক্ষতিকর আওয়াজ প্রদানকারী হর্ন বাজানো হচ্ছে সর্বদা। অন্যদিকে চালকদের বক্তব্য হচ্ছে, অতিরিক্ত আওয়াজের হর্ন দিয়েই মানুষের অসচেতন চালচলন কমানো যাচ্ছে না। দুর্ঘটনার দায় দিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছে বাস মালিক কর্তৃপক্ষ। অথচ ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে অসহায় শিক্ষার্থী, রোগী ও সাধারণ মানুষকে। ফলে দুর্বল হয়ে যেতে হচ্ছে অসুস্থতার কাছে। সর্বনাশ হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশে। চালক দোষারোপ করছে পথচারীদের, পথচারী আঙুল তুলছে অন্যের ওপর। এভাবে আর কত দায় এড়িয়ে চলতে হবে! এসব অসাবধানতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হয়তো আপনার আমার পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য। লাভ তো কোথাও হচ্ছে না। মানবতার দিক থেকে একে অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা একজন আদর্শ মানুষের কর্তব্য। প্রত্যেকে আপন স্থান থেকে শুধরে গেলে সমাজের উন্নতি ও মানবজাতির কল্যাণ সাধন সম্ভব।
নির্বিঘ্নে ক্ষতি করছে গাড়ির কালো ধোঁয়া
গাড়ি যেমন মানব সমাজের উপকারে নিয়োজিত, তার থেকে বেশি ক্ষতি করছে গাড়ির দূষিত কালো ধোঁয়া। পৃথিবীর অন্যসব কালোতে উপকার থাকলেও এ কালো ধোঁয়া তার আকৃতির ন্যায় খারাপ; মানবদেহের জন্য বিষ। ধোঁয়া নাকে যাওয়া থেকে দম বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভেতরে গিয়ে দেহের বড় ক্ষতি করে। অধিকাংশ লোক মনে করেন, ধোঁয়াতে আর তেমন কী ক্ষতি! কিন্তু গাড়ির এ ধোঁয়া আপদমস্তক ক্ষতিতে পূর্ণ। অসুস্থ বাহনের এ দূষিত বাতাস মানবদেহে ফুসফুসে ক্ষতি করে ও ক্যান্সারের জন্ম দেয়। এসব ধোঁয়া উৎপন্ন হয় গাড়ির মবিল পরিবর্তন না করলে এবং ডিজেলের পরিবর্তে সস্তায় কেরোসিন ব্যবহারে। গাড়ির খরচ বাঁচার দোহাই দিয়ে এসব অসতর্ক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত অনেক পরিবহন মালিক। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যায়, গাড়ির দেখাশোনায় অবহেলা ও সস্তা তেল ব্যবহারে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বাহনের আয়ু কমে যাচ্ছে। সবশেষে ফলাফল লসে লস! কথায় আছে, আপন বুঝ পাগলেও বোঝে। অবাক করা বিষয় হলো, আমরা এতটাই সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, এত শত সতর্কতা, বিধি-নিষেধের পরেও কোনো পরিবর্তন নেই। যেন একেকজনের কান সিসা দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে।
সড়কপথে এবড়োখেবড়ো গাড়ি চালনা
যেখানে সেখানে অহেতুক হর্ন বাজানো, দূষিত ধোঁয়া ছাড়াও বড় ব্যাধি হয়েছে এবড়োখেবড়ো গাড়ি চালানো। সড়কপথ হয়ে উঠেছে অলিম্পিকের আসর। কে কার আগে কীভাবে যাবে, তা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু অসতর্ক কিছু চালকদের এমন দুঃসাহস কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্পাপ যাত্রীদের। অনেকে রাজপথের বাহনগুলোকে মৃত্যুর দূত বলে সম্বোধন করেন। যাত্রীদের জন্য সড়কে চলাচল জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে শুধু সীমালঙ্ঘনের সয়লাব। কবে এসব অসংগতি লোপ পাবে! পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাওয়া আদৌ সম্ভব একটা সুস্থ সমাজ! নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা বিশ্ববাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর রহম করবেন।’ (তিরমিজি : ১৮৪৭)।