ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বৃষ্টি আল্লাহর লীলাময় সৃষ্টি

বৃষ্টি আল্লাহর লীলাময় সৃষ্টি

বৃষ্টি আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের নিদর্শন। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ দুনিয়ায় কল্যাণ ও রিজিকের ব্যবস্থা করেন। কোরআনের বহু আয়াতে বৃষ্টির উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। বৃষ্টি এলে মানুষের মন প্রফুল্ল হয়। আল্লাহতায়ালার অপূর্ব সৃষ্টি এই বসুন্ধরা। মানুষের জন্য বৈচিত্র্যময় উপকারী উপকরণসমৃদ্ধ করে আল্লাহতায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনেই নিগূঢ় কোনো রহস্য বিদ্যমান আছে। আছে সৃষ্টিজগতের কোনো না কোনো শ্রেণির কল্যাণকামিতা। পৃথিবীতে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সৃষ্টিরাজি থেকে আল্লাহতায়ালা মানব সন্তানকে শিক্ষা গ্রহণের আদেশ করেছেন। সৃষ্টির প্রতিটি অঙ্গজুড়েই পৃথক পৃথক শিক্ষা রয়েছে। রয়েছে আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ ও তৌহিদের মহান শিক্ষা, ঈমান আনয়নের অফুরন্ত নিদর্শন। পানি-বৃষ্টি আল্লাহতায়ালার মহাদান। পানিহীন পৃথিবীর অস্তিত্ব অকল্পনীয়। ধরাপৃষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশজুড়েই রয়েছে পানি। কোরআনে আল্লাহতায়ালা বৃষ্টির বৈচিত্র্যময় দিক আলোচনা করেছেন। নিজের কুদরত, বরকত ও শক্তির কথা ঘোষণা করেছেন। এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহতায়ালার বন্দেগিতে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করার প্রতি বিশ্ববাসীকে আহ্বান করেছেন।

জমি জীবন্তকরণ ও ফল উৎপাদন

সৃষ্টিকুলের জীবনধারণের সব উপকরণ আল্লাহতায়ালা পরিমিতভাবে ও যথাস্থানে স্থাপন করে রেখেছেন। সবুজাভ প্রকৃতি, শ্যামলি-নিসর্গ ও বনভূমির মাধ্যমে তিনি প্রকৃতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তা ভারী মেঘমালাকে বয়ে নিয়ে যায়, তখন আমি তাকে কোনো মৃত ভূখণ্ডের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাই। তারপর সেখানে পানি বর্ষণ করি। তা দ্বারা সর্বপ্রকার ফল উৎপন্ন করি।

এভাবেই আমি মৃতদেরও জীবিত করে তুলব। হয়তো তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে।’ (সুরা আরাফ : ৫৭)। অপর আয়াতে বলেন, ‘তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, তারপর যখন আমি তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও বাড়ন্ত হয়ে ওঠে। তা উৎপন্ন করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ।’ (সুরা হজ : ৫)। আয়াত দুটি মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দানের কথা প্রমাণ করছে।

পবিত্রতা ও অন্তরে দৃঢ়তা অর্জন

কোরআনুল কারিমে ঘোষিত হয়েছে, ‘স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের ভীতি দূর করার জন্য তোমাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন করছিলেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর পানি বর্ষণ করছিলেন, তা দ্বারা তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের ময়লা দূর করার জন্য, তোমাদের অন্তরে দৃঢ়তা বাঁধার জন্য এবং তার মাধ্যমে (তোমাদের) পা স্থির রাখার জন্য।’ (সুরা আনফাল : ১১)।

বৃষ্টি সবকিছু বিনাশকারী

কোরআনে কারিমে এসেছে, ‘সে বলল, আমি এখনই এমন এক পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে পানি থেকে রক্ষা করবে। নুহ বলল, আজ আল্লাহর হুকুম থেকে কাউকে রক্ষা করার কেউ নেই; শুধু সে ছাড়া, যার প্রতি আল্লাহ দয়া করবেন। অতঃপর ঢেউ তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং সেও নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’ (সুরা হুদ : ৪৩)।

বৃষ্টির পানির স্বাদ ভিন্ন

ঘোষিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে আছে বিভিন্ন ভূখণ্ড, যা পাশাপাশি অবস্থিত। আর আছে আঙুরের বাগান ও খেজুর গাছ। যার মধ্যে কিছু একাধিক কাণ্ডবিশিষ্ট এবং কিছু এক কাণ্ডবিশিষ্ট। এসব একই পানি দিয়ে সিঞ্চিত হয়। আমি স্বাদে তার কিছুকে অন্যগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এসব বিষয়ের মধ্যে সেসব লোকের জন্য নিদর্শন আছে, যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায়।’ (সুরা রাদ : ৪)। অর্থাৎ কোনো গাছে বেশি ফল ধরে, কোনো গাছে কম এবং কোনো গাছের ফল বেশি স্বাদযুক্ত এবং কোনো গাছের ফল ততটা স্বাদের নয়।

পাথর থেকে পানি সৃষ্টি

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়। তার মধ্যে কিছু এমন আছে, যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার তার মধ্যে এমন পাথরও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।’ (সুরা বাকারা : ৭৪)।

বৃষ্টির পানি পবিত্র

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি পবিত্র পানি। তা দিয়ে মৃত ভূমিকে সঞ্জীবিত করা এবং আমার সৃষ্ট বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করানোর জন্য।’ (সুরা ফোরকান : ৪৮-৪৯)।

পানি সংরক্ষণ করেন আল্লাহ

ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি আকাশ থেকে পরিমিতভাবে পানি বর্ষণ করি, তারপর তা ভূমিতে সংরক্ষণ করি। নিশ্চিত জেনে রেখ, আমি তা অপসরণ করতেও সক্ষম।’ (সুরা মোমিনুন : ১৮)। আকাশ থেকে আমি যে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তোমাদের যদি তা সংরক্ষণ করার দায়িত্ব দেয়া হতো, তবে তোমাদের পক্ষে তা সম্ভব হতো না। আমি এ পানি পাহাড়-পর্বতে বর্ষণ করে বরফ আকারে জমা করে রাখি। তারপর সে বরফ গলে গলে নদ-নদীর সৃষ্টি হয়। তা থেকে শিরা-উপশিরারূপে সে পানি ভূগর্ভে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাটির স্তরে স্তরে তা জমা হয়ে থাকে। কোথাও কুয়া ও প্রস্রবণের সৃষ্টি হয়। আল্লাহর রহমতে প্রকৃতিতে প্রকাশ পায় স্বস্তির ছাপ।

আল্লাহর রহমত কামনা করা

বৃষ্টি একদিকে যেমন রহমতের, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজাবও হতে পারে। এ কারণে রাসুল (সা.) বৃষ্টি দেখলেই মহান আল্লাহর কাছে উপকারী বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; বৃষ্টি এলে রাসুল (সা.) বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা সায়্যিবান নাফিআহ।’ (অর্থ : হে আল্লাহ, তুমি এ বৃষ্টিকে প্রবহমান এবং উপকারী করে দাও)। (সুনানে নাসায়ি : ১৫২৩)।

ঝোড়ো হাওয়া বইলে আল্লাহকে ভয় করা

রাসুল (সা.) কখনও দমকা হাওয়া ও মেঘের ঘনঘটা দেখলে তার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠত। তিনি আগে-পেছনে উদ্বিগ্ন হয়ে চলাফেরা করতেন। এরপর যখন বৃষ্টি হতো, খুশি হয়ে যেতেন। তার থেকে এ অস্থিরতা দূর হয়ে যেত। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা হয়, আমার উম্মতের ওপর কোনো আজাব এসে পড়ে কিনা।’ তিনি বৃষ্টি দেখলে বলতেন, ‘রহমাতান।’ (এটি আল্লাহর রহমত)। (মুসলিম : ১৯৬৯)। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) আকাশের প্রান্তে মেঘ উঠতে দেখলে যাবতীয় (নফল) ইবাদত ছেড়ে দিতেন, এমনকি তিনি নামাজে থাকলেও। অতঃপর বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে এর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই।’ যদি বর্ষা হতো, তাহলে বলতেন, ‘হে আল্লাহ, বরকতপূর্ণ ও সুমিষ্ট পানি দান করুন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫১৯৯)।

বৃষ্টির পানি স্পর্শ করা

আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়। তখন রাসুল (সা.) তার কাপড় খুলে দিলেন। ফলে তাতে বৃষ্টির পানি পৌঁছে যায়। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এরূপ কেন করলেন?’ তিনি বললেন, ‘এটা মহান আল্লাহর কাছ থেকে অল্প সময় আগে এসেছে।’ (মুসলিম : ১৯৬৮)।

বৃষ্টিতে কল্যাণের দোয়া

বৃষ্টির সময় কল্যাণের দোয়া করা চাই। যখন বৃষ্টি হয়, তখন বৃষ্টি থেকে উপকার পেতে দোয়া করা জরুরি। বৃষ্টি শুরু হলে রাসুল (সা.) কল্যাণ ও উপকার পেতে বেশি বেশি দোয়া করতেন। বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। কারণ, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বৃষ্টির সময়ের দোয়া কবুল হয়ে থাকে।’ (তাবারানি মুজামুল আওসাত : ৫৭৫৬)।

অতিবৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোয়া

অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে আল্লাহর কাছে অতিবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দোয়া করতে হবে। রাসুল (সা.) একবার অতিবৃষ্টিতে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা আলাইনা।’ (অর্থ : হে আল্লাহ, তুমি আমাদের আশপাশে বৃষ্টি বর্ষণ কর, আমাদের ওপর নয়)। (সুনানে নাসায়ি : ১৫২৭)। উল্লেখ্য, এখানে এটি উদ্দেশ্য নয় যে, আমাদের পাশের এলাকা ডুবিয়ে দাও; বরং উদ্দেশ্য হলো, জনবসতিহীন কোথাও বৃষ্টি সরিয়ে নাও।

বৃষ্টি শেষে দোয়া পড়া

উপকারী বৃষ্টির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ বৃষ্টি সবার জন্য উপকারী হতে কিংবা বৃষ্টি বন্ধ হলে দোয়া করা সুন্নত। রাসুল (সা.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি (বৃষ্টির পর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে) এ দোয়া পাঠ করে, সে আমাকে বিশ্বাস করে, আর তারকায় (তারার শক্তিতে) অবিশ্বাস করে। তা হলো- মুতিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রহমাতিহ।’ (অর্থ : আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে)। বৃষ্টি শেষে রাসুল (সা.) সাহাবিদের এই বিশেষ দোয়া পড়ার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। (বোখারি : ১০৩৮)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত