মরুর বুকে বেলালের স্মৃতি
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মিনহাজুল আরিফীন মক্কা থেকে
ধক করে একটা আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে বিমান থামল, ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ৫টা। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের জগতে নজর রাখলাম। এই তো নবীর দেশ, ইসলামের পবিত্র ভূমি, কোরআন নাজিলের দেশ, ইসলামের হাজার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি। অপলক তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। জেদ্দা বিমানবন্দরের বিশালতা দেখে খানিকটা অবাক হলাম। হারিয়ে গেলাম নানা চিন্তার অথৈ সাগরে। ভাবতে ভাবতে কখন যে বিমান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে আমাদের উগরে দিল এক জ্বলন্ত উনুনে, টের পেলাম না। সবে ভোর হলো; কিন্তু আবহাওয়ায় তা অনুভবের জো নেই। বিমান থেকে নামামাত্র এক দলা গরম ঢেকে নিল। অথচ এখনও সূর্যের শরীর দেখিনি। তার ওপর অবস্থান করছি রাস্তার পাশে বিশাল অট্টালিকার ছায়ায়। তাতেও যেন কমেনি আরবীয় উষ্ণতার আধিপত্য।
মক্কার আকাশে গনগনে রোদ
আমরা তেপ্পান্নজন হাজীর এক কাফেলা। ফজরের পর জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে সূর্য তেতে ওঠার আগেই হোটেলে পা রাখলাম। ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারলাম না আরবীয় রোদের তেজস্ক্রিয়তা। মক্কার সর্বোচ্চ ক্লক টাওয়ারের পাশেই আমাদের হোটেল। দৃষ্টি আটকাল বৃহদাকার ওই ঘড়ির কাঁটায়। বেলা তখন তিনটে ছুঁইছুঁই। মক্কার আকাশে গনগনে রোদ। মনের জেদ মিটিয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে আরবীয় তেজস্বীতে। ঝাঁঝালো তপ্ত হাওয়া চেহারায় ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে পড়ছে। যেন ঠিক উত্তপ্ত চুলোর মুখে বসে আছি। পিচঢালা পথ যেন রুটি বানানোর ভাপা তাওয়া। প্রথম দিনেই জুতা হারিয়ে পায়ে ঠোসা ফেলে টনক নড়েছে, এ দেশে চপ্পলহীন নগ্নপায়ে চলার ফুরসত নেই। যতবারই আরবের এ দোর্দণ্ড রোদের কাছে এসেছি, ততবারই জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডের কথা মনে পড়েছে। মনটা তখন অজান্তেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নুয়ে পড়েছে মহাপরাক্রমশালীর আলীশান দরবারে।
মক্কায় লালিত ছিলেন বেলাল (রা.)
সহসাই মনে এক চিন্তার উদয় হলো। তবে কি এ ভয়াবহ রোদেই বেলাল (রা.)-কে পাষ- কাফেররা ফেলে নির্যাতন করেছিল? ভাবতেই মনটা উচাটন হলো। ভেতরটা যেন হু হু করে কেঁদে উঠল। ইসলাম গ্রহণের কারণে বেলাল (রা.)-কে যে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম মানুষকেই এমন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার পিতার নাম ছিল রাবাহ। মাতার নাম হামামাহ। তার মা ছিল মক্কার হাবশি বা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসীদের একজন। সে কারণে কেউ কেউ তাকে কালো দাসীর ছেলে বলেও ডাকত। বেলাল (রা.) লালিত-পালিত ছিলেন মক্কায়। তিনি ছিলেন আবদুদ দার গোত্রের কয়েকজন এতিম বালকের ক্রীতদাস। মৃত্যুর আগে তাদের পিতা কাফেরদের নেতা উমাইয়া ইবনে খলফকে তাদের অভিভাবক নিযুক্ত করে যান।
উমাইয়া ও তার সঙ্গীদের নির্যাতন
এমন এক সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, যখন পৃথিবীর বুকে তিনিসহ হাতেগোনা কয়েকজন লোক ছাড়া আর কোথাও মুসলমানদের অস্তিত্ব ছিল না। ওই সময়ে ইসলাম গ্রহণকারী প্রভাবশালীদের ওপর মুশরিক নেতৃবৃন্দ কোনো নির্যাতন করার সাহস পেত না। কারণ, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো তাদের শক্তিশালী আত্মীয়স্বজন ছিল। পক্ষান্তরে দুর্বল দাস-দাসীদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব ছিল না। ফলে অসহায়-দুর্বলদের ওপর কোরাইশ নেতারা চাপিয়েছে নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার। এ অসহায় লোকদের ওপর নির্যাতন চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিল একদল কঠিন ও নির্দয় কোরাইশি কাফের। আবু জাহেল সুমাইয়া (রা.)-কে হত্যা করে এ দায়িত্ব পালনে সর্বপ্রথম কৃতিত্ব দেখায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই পাষ- কাফেরদের অত্যাচার ছিল চরম অমানবিক। এ ধারাবাহিকতায় বেলাল (রা.)-কে নির্যাতন করার দায়িত্ব নিয়েছিল উমাইয়া ইবনে খলফ এবং তার পাষাণ হৃদয়ের কিছু সঙ্গী।
দাঁতে দাঁত চেপে ঝাঁপিয়ে পড়ল
৬১০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। সময়টা ছিল মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত নাজুক। নতুন ধর্ম ইসলামের আলোয় মক্কানগরী তখন ক্রমেই আলোকিত হয়ে উঠছে। মহানবী (সা.) আল্লাহর হুকুমে কালিমার দাওয়াত দেয়া শুরু করেছেন। বেলাল (রা.) তখন সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সৌভাগ্যবানদের একজন। অতি গোপনে ইসলামের বিধানগুলো পালন করে যাচ্ছিলেন। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকেও দিনকাল ভালোই গড়াচ্ছিল তার। কিন্তু হঠাৎ একদিন মক্কায় খবর ছড়িয়ে পড়ল, কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস বেলাল কোরাইশদের ধর্ম অস্বীকার করে মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছে। বিষয়টি কোরাইশ গোত্রপতিদেরও কান এড়াল না। বেলাল-মনিব উমাইয়া ইবনে খালফের কর্ণকুহরে যখন এ খবর পৌঁছাল, রাগে-আক্রোশে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল উমাইয়া। হাতে ছড়ি নিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরীহ বেলালের ওপর। নেমে এলো ইতিহাসের নৃশংসতম অত্যাচারযজ্ঞ। নানা কায়দায় একের পর এক চলতে থাকে অবর্ণনীয় সব নির্যাতন। চাবুকের সপাং সপাং আঘাতে ক্রমেই নীল হয়ে উঠল বেলালের জীর্ণ শরীর।
মুখে আহাদণ্ডআহাদ উচ্চারণ
নির্যতনকারীরা একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তারপরও থামল না পাষ-ের দলেরা। পালাক্রমে চালাতে থাকল চাবুক। একের পর এক চাবুকাঘাতে একপর্যায়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল বেলালের জীর্ণশীর্ণ দেহ। তবুও ছাড়ল না পাষাণেরা। একদল উগ্র ছেলেকে লেলিয়ে দিল বেলালের পেছনে। তারা বেলালের গলায় রশি বেঁধে কংকর ও বালুকাময় মরুর পথ ধরে টানাহেঁচড়া করতে লাগল। জ্বলন্ত কয়লা আর প্রখর রোদের উত্তপ্ত বালিয়াড়ির ওপর শুইয়ে বুকের ওপর এক প্রকার পাথর দিয়ে রাখল। নিচে কখনও তাপদগ্ধ উত্তপ্ত বালুরাশি, কখনও আবার জ্বলন্ত কয়লার অঙ্গার, ওপরে প্রকাণ্ড জগদ্দল পাথর। ফলে বেলালের শরীর ফেটে অঝোরে রক্ত ঝরল। সে রক্তের আর্দ্রতায় কয়লার আগুনও নিভে গেল। কিন্তু গলল না নির্দয়দের হৃদয়। এককথায়, বর্বরতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল মুশরিকরা। নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করেছিল এ নিরীহ মানুষটির ওপর। একটাই ছিল অপরাধ, মুশরিকদের লাত, মানাত, উজ্জার পূজা ছেড়ে এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন বেলাল (রা.)। এত এত কষ্ট স্বীকার করার পরও ঈমানের পথে ছিলেন পাহাড়সম অটল ও অবিচল। মুখে ছিল কেবল আহাদ, আহাদ উচ্চারণ। তার কাছে এ শব্দই যেন ছিল অমৃতের মতো। বুকের বিতানে তৌহিদের অনিঃশেষ আলো আছে যার, তার কাছে এমন লোমহর্ষক নির্যাতনও যেন ঠুনকো। তা-ই প্রমাণ করে গিয়েছিলেন বেলাল (রা.)।
বেলালকে আগে আগে যেতে দেখলাম
বেলাল (রা.) শত কষ্ট-দুঃখ সহ্য করেও ইসলাম ত্যাগ করেননি। দেখিয়েছেন ঈমানের ওপর অটল অনড় থাকার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; যা ইতিহাসের পাতার স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। এভাবেই গড়াচ্ছিল দিনের পর দিন। একদিন মক্কার প্রখ্যাত দানবীর আবু বকর (রা.) মক্কার পথ ধরে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বেলালের এ করুণ অবস্থা দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তৎক্ষণাৎ ছুটে যান উমাইয়ার কাছে। উচ্চমূল্যে বেলালকে কিনে এনে আজাদ করে দিলেন আল্লাহর রাহে। হ্যাঁ, তারাই ছিলেন নবীজি (সা.)-এর প্রকৃত আশেক ও জানবাজ সাহাবি। পরে নবীজি (সা.) তাকে মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন। প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য তিনি প্রাণের সবটুকু দরদ দিয়ে আবেগঢালা সুরে আজান দিতেন। ইনিই ছিলেন সেই বেলাল, যার সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আমি শবেমেরাজে যখন জান্নাতে ভ্রমণ করছিলাম, তখন বেলালকে আমার আগে আগে যেতে দেখলাম।’