মফস্বল থেকে আন্তর্জাতিক মানসিকতাসম্পন্ন, ছাত্র গড়ায় সুনিপুণ কারিগরের ভূমিকায় উত্তীর্ণ, ঝড়েপড়া ছাত্রদের নিজ সন্তানের মতো গড়ে তোলা বিশ্বমানের হাফেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে যার খ্যাতি ‘হরষপুরের হাফেজ’ নামে; তিনি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন হাফেজ নুরুজ্জামান (রহ.)। যিনি একাধারে ছিলেন লেখক, অনুবাদক, গবেষক ও সুসাহিত্যিক। ২৭ মে ২০২৩ (শনিবার) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। তার ইন্তেকালে ছাত্র-শিক্ষক, আলেমণ্ডওলামা ও সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমেছে।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
১৯৪৮ সালে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ১নং ধর্মঘর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। নিজ এলাকায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে বাবা মুনশি আজিজুর রহমানের স্বপ্ন পূরণে সরাইলের প্রসিদ্ধ হাফেজ আবদুল হান্নান (রহ.)-এর কাছে হাফেজি পড়া আরম্ভ করেন। মেধাবী বালকের হিফজ পড়তে মন বসছিল না; কিন্তু বাবার স্বপ্ন ছিল, তাকে হাফেজ হতেই হবে। তাই চেষ্টা চালিয়ে যান।
লেখালেখি ও সাহিত্য সাধনা
তিনি ছিলেন লেখক, সুসাহিত্যিক ও গবেষক। জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ার সময় প্রথম লেখা দৈনিক আজাদীতে ছাপা হয়। এ লেখাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ছাত্র অবস্থায় সমাজের অসংগতি নিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে লিখতে থাকেন। তার লেখা পড়ে অনেকে আশ্চর্য হতেন, এত অল্প বয়সে এত সুন্দর গোছালো ও পরিপাটি লেখা কীভাবে সম্ভব! তিনি ‘ফখরে বাঙ্গাল ও তার সাথীবর্গ’ নামে ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.)-এর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। বইটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষকতা ও ফলাফল
১৯৭৪ সালে তার বাল্যবন্ধু বর্তমান হরষপুর মাদ্রাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মাওলানা সিরাজুল ইসলাম খান তার মাধ্যমে হাজী সাহেব আলী খানের বাড়ি হেফজখানা শুরু করেন। তিনি নিরলস মেহনতের সঙ্গে সেখানে ৫০ বছর যাবত শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় তার হাতে হাজার হাজার ছাত্র হাফেজ হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুফতি নুরুল্লাহ (রহ.)-এর কয়েকজন সন্তান, হবিগঞ্জের আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী (রহ.)-এর সন্তান ও বরুনা পরিবারের অনেকেই তার আদর, সোহাগ ও শাসনের মধ্য দিয়ে হাফেজ হয়েছেন।
শিক্ষকতায় অনন্য নীতি
তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বপ্নবাজ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি। ঝড়েপড়া ও অসচ্ছল পরিবারের ছেলেদের পাশে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দাঁড়াতেন তিনি। কোনো ছাত্র বাড়ি চলে গেলে, পড়ালেখা ছেড়ে দিলে, তাদের বাড়িতে হেঁটে যেতেন। ঝড়েপড়া ছাত্র ও তার পরিবারের লোকদের বুঝিয়ে মাদ্রাসায় ফিরিয়ে আনতেন। এই ছেলেরা যোগ্যতাসম্পন্ন হাফেজ ও আলেম হয়েছেন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত আছেন। তার এ অসাধারণ ও নির্মল গুণ সাধারণ মানুষকেও আকৃষ্ট করত।
পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা
৭৫ বছর বয়সে তার ইন্তেকাল হয়। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বড় ছেলে হাসান জুনাইদ মাওলানা ও মুফতি। ছোট ছেলে মাদ্রাসায় মেশকাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন; পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। মেয়েরাও আলেমা। তাদের জামাতারাও প্রসিদ্ধ আলেম। নাতি-নাতনিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন হাফেজ, হাফেজা এবং আলেম রয়েছেন।
বড়দের সঙ্গে ওঠাবসা
তিনি ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.), মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর (রহ.) ও মুফতি নুরুল্লাহ (রহ.)-এর হাতেগড়া ছাত্র। মাআরেফুল কোরআনের অনুবাদক মাওলানা মুহীউদ্দিন খান (রহ.)-এর সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে তিনি মাওলানা মুহীউদ্দিন খান (রহ.)-কে চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছিলেন। দাওয়াত পেয়ে মাওলানা খান (রহ.) ঢাকা থেকে লোকাল ট্রেনে হরষপুর গিয়েছিলেন।
লেখক : খতিব, পীর ইয়ামেনী জামে মসজিদ, গুলিস্তান, ঢাকা; প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, মারকাজুশ শাইখ আরশাদ আল মাদানি, মানিকনগর, ঢাকা