হজ ইসলামের নির্মল শিক্ষা গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ লাভের মাধ্যম। হজ প্রচলিত ও নির্দিষ্ট বাহ্যিক কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরে হজে এমন অনেক গভীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ রয়েছে, যা অনুধাবন না করে শুধু ওই আচারগুলো সম্পাদন করলে এর প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। কোনো হাজী যদি হজের সফরের মর্ম অনুধাবন করে, তবেই সে হজ ও এর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নিহিত গভীর রহস্য ও আধ্যাত্মিক দর্শন বুঝতে পারবে। আলী খামেনেয়ি বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা সারা জীবনে শুধু একবার তাঁর বান্দার ওপর হজ ফরজ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, বান্দা যদি এর প্রকৃত মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে তা একবার সম্পন্ন করে, তা-ই তাকে স্রষ্টার কাছে পৌঁছে দেবে। তার জন্য তা দ্বিতীয়বার সম্পাদনের প্রয়োজন নেই।’ (খামেনেয়ি, ১৩৮৭ ফার্সি সাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৯-১৫০)। তাই হজের অন্তর্নিহিত রহস্য ও তাৎপর্যকে যথাযথ অনুধাবনের মাধ্যমেই এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব, যা শেষ জীবন পর্যন্ত হাজীর জন্য পাথেয়। ইমাম যাইনুল আবেদীন, আলী ইবনে হোসাইন এ বিষয়ে শিবলিকে যা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘হজের প্রতিটি আমল ও আচার-অনুষ্ঠানের পেছনে সত্য ও বাস্তব একরূপ রয়েছে, তার অনুসন্ধান কর। যদি তা না কর, তবে তুমি যেন ইহরামই বাঁধনি, লাব্বাইকও বলনি, তাওয়াফও করনি।’ (নূরি, ১৪০৮ হিজরি, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৬৬-১৬৭)।
ইসলামের মহান শিক্ষার সারগর্ভ নির্দেশক বাণী
যদিও হজ জীবনের বিভিন্ন দিকে বিশেষত ব্যক্তিগত ও সামাজিক নৈতিকতার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত; কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামের এ মহান স্তম্ভটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে অতি ক্ষুদ্র কিছু প্রভাব রাখছে; বরং বলা যায়, মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান অনেক কষ্ট করে ওহির প্রারম্ভিক অবতীর্ণ ভূমিতে সমবেত হয়; কিন্তু তারা এ আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইবাদত থেকে যা অর্জন করা উচিত ছিল, তা থেকে উদাসীন। ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর হজযাত্রীদের জন্য একজন নেতা নিযুক্তকরণ, মক্কায় গমণকারী হজযাত্রী এবং তাদের পরিচালনা ও নির্দেশনাদানকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রতি সহৃদয় তাগিদপূর্ণ উপদেশ দান, ইরান থেকে যাত্রার আগে এ মহান সম্মিলনে নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের করণীয় বিষয়ে স্মরণ, বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে যেসব হাজী মক্কায় ও আরাফায় সমবেত হয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্যে ইসলামের মহান শিক্ষার পূর্ণ সারগর্ভ দিকনির্দেশক বাণী- ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে হজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে।
ঐশী কল্যাণ সাধনে হজ মুসলমানদের অপূর্ব সুযোগ
ইমাম খোমেনির মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধন ও স্বার্থরক্ষার জন্য হজ থেকে যথার্থ উপকৃত হওয়ার বিষয়টি তার স্থলাভিষিক্ত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। তারই ছাত্র ও যোগ্য উত্তরসূরি এ নেতা তার পূর্বসূরির প্রবর্তিত সুন্দর ধারাটি চলমান রেখেছেন। তিনি প্রতিবছর হজের মৌসুম আসার প্রাক্কালে ও হজের পর হজ কাফেলার পরিচালক ও বিভিন্ন দায়িত্বশীলদের সঙ্গে সাধারণ ও বিশেষ যে সাক্ষাৎ করেন এবং হজের জন্য বিশেষ যে বাণী প্রদান করেন, তাতে এ সম্মিলিত ইবাদতের বিভিন্ন দিক বিশেষত এ মহাসমাবেশটি মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে ভাগ্য নির্ধারক ভূমিকা রাখতে পারে, তা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে কঠিন দায়িত্ব রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেন। এ ঐশী সমাবেশ যে মুসলমানদের জন্য মূল্যবান এক সুযোগ এনে দিয়েছে, তাদের উচিত এ থেকে সর্বোচ্চ উপকৃত হওয়া, তিনি তা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। অন্যতম যে বিষয়টির ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন, তা হলো- হজের সম্ভাবনাময় নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলো খুঁজে বের করা।
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে চেষ্টা-সাধনা প্রয়োজন
একদিকে যদি মানুষ নিজেকে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুনিয়ার আসক্তির সব উপাদান থেকে মুক্ত করে নিজের মধ্যে ও তার চারপাশে বিদ্যমান মহামূল্যবান যে মূলধন ও নেয়ামতগুলো আল্লাহ তাকে দিয়েছেন, যেগুলো সে কোনোরূপ পরিশ্রম ছাড়া এমনি এমনিই লাভ করেছে, তা নিয়ে চিন্তা করে অন্যদিকে তার সৃষ্টির মূল লক্ষ্য কি- তা নিয়ে গভীরভাবে অনুধাবন করে, তখন বুঝতে পরবে- অবশ্যই আল্লাহর নৈকট্যের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাকে বিভিন্ন সুযোগকে চেনা ও তা কাজে লাগানোর পদ্ধতিও শিখতে হবে।
প্রতিটি মানুষই তার জীবনের কোনো কোনো সময় বিশেষ সুযোগ লাভ করে থাকে, যাকে কাজে লাগানো আবশ্যক। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে লোকসকল! নিঃসন্দেহে তোমাদের জীবনে কিছু কিছু বিশেষ মুহূর্ত আসে; তোমরা সুবর্ণ এ সুযোগগুলোর অপেক্ষায় থেক। তার থেকে উদাসীন হয়ো না।
কেননা, করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সে সময় জীবন সঞ্চারী মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হয়।’ (কুলাইনী, ১৪০৭ হিজরি, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৬৫০)।
হজে মুসলমানদের এক কেন্দ্রে মনোনিবেশ
সমাজের কিছু সৌভাগ্যবান লোকের জন্য যে সুযোগগুলো আসে, তার অন্যতম হলো হজের মৌসুম। এ সুযোগটি খুব কম সংখ্যক লোকের জন্য এবং তাদের অনেকের জন্যই তাদের জীবনে একবার হয়। অন্যদিকে হজ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা অন্য কোনো সামষ্টিক ইবাদতের মধ্যে পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সুযোগকে বিশেষভাবে অনুভব করতে ও গুরুত্ব দিতে হবে। ১৩৮৮ ফার্সি সালে দেয়া হজবাণীতে আলী খামেনেয়ি বলেন, হজকে একটি ঐশী মহান নেয়ামত ও অপূর্ব এক সুযোগ বলে গণ্য করতে হবে। হজের একটি আশ্চর্য ঘটনা রয়েছে, যদিও আমরা এর প্রতি উদাসীনতার কারণে একে এক সাধারণ ঘটনা হিসেবে গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ফলে এর গুরুত্ব ও মহান মর্যাদার প্রতি সঠিকভাবে দৃষ্টি দিই না। হজের দিনগুলোতে সব মুসলমান সমবেতভাবে একটি কেন্দ্রের দিকে মনোনিবেশ করে। আমাদের এ দৃষ্টিকোণ থেকেই হজের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। আলী (রা.) বলেন, ‘সুযোগ মেঘের মতো অতিক্রম করে চলে যায়; অতএব, সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে কল্যাণ অর্জন কর।’ (হুররে আমেলি, ১৪০৯ হিজরি, ১৬তম খণ্ড, পৃ. ৮৪)।
হজ ইসলামের সত্যরূপ প্রচারে সুবর্ণ সুযোগ
মানুষের সামনে আসা কোনো বিশেষ সুযোগকে কাজে লাগানোর পূর্বশর্ত হলো, সে সুযোগকে সঠিকভাবে চিনবে ও তার গুরুত্ব বুঝবে। যদি সে ওই অবস্থা ও সময়কে সুযোগ বলে মনে করে, তবেই চেষ্টা করবে তাকে হাতছাড়া না করতে এবং সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে। আর যদি সে সুযোগ বলে মনে না করে, তবে তা হাতছাড়া করবে। ইমাম খোমেনি ইসলামি বিপ্লবের আগেও ইরানের জনগণকে হজ ইসলামের সত্যরূপ প্রচারের এক সুবর্ণ সুযোগ বলে অবহিত ও সচেতন করতেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে ইসলামের অনুসারী প্রিয় ইরানি জাতি! তোমরা যারা হজের অনুষ্ঠান পালনের জন্য ওহির অবতীর্ণ হওয়ার স্থানে সমবেত হয়েছ, তোমাদের জন্য আবশ্যক হলো, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের মুক্তির উপায় খুঁজে বের করা।’ (খোমেনি, ১৩৭৮ ফার্সি সাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১)।
ইসলামি উৎসসমূহে সুযোগকে চেনার গুরুত্ব
ইসলামি বিপ্লবের নেতা আলী খামেনেয়ি হজের প্রকৃত পরিচয় দানের জন্য বলেন, ‘হজের প্রতি একটি সুযোগ ও সম্ভাবনাময় দৃষ্টি দিতে হবে। যদি আমরা একে একটি সুযোগের দৃষ্টিতে দেখি, তবেই আমাদের চোখ খুলবে এবং আমাদের দায়িত্বের প্রতি অধিক মনোযোগী হব। আপানারা হজে আল্লাহর ঘরের পাশেই অন্য মুসলমানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহর বন্দেগি করার সুযোগ পান। যদি সুযোগের দৃষ্টিতে দেখা হয়, তখন তার অবধারিত পরিণতি হলো, মানুষ কোনো অবস্থাতেই এ সুযোগকে হাতছাড়া করবে না।’ (খামেনেয়ি, ১৩৮৮ ফার্সি সালে হজ কাফেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ)। ইসলামি উৎসসমূহে সুযোগকে চেনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। যতক্ষণ এ পরিচয় জ্ঞান অর্জিত না হবে, ব্যক্তি তা থেকে উপকৃত হওয়া ও তাকে কাজে লাগাতে উদ্যত হবে না। আলী (রা.) বলেন, ‘সুযোগগুলোকে অতীব মূল্যবান মনে কর এবং সময়ের সন্তান হও (সময়োপযোগী কাজ কর ও সময় সচেতন হও)।’ (ইবনে আবিল হাদিদ, ১৪০৪ হিজরি, ১৯তম খণ্ড, পৃ ২৫৫)।