যত্রতত্র ময়লা ফেলা অনুচিত

মিনহাজুল আরিফীন

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীতে মানুষের জন্য আবশ্যকীয় বিষয়গুলোর অন্যতম একটি হলো, পথ বা রাস্তা। পার্থিব প্রয়োজনে মানুষকে বাড়িতে প্রবেশ ও বের হওয়া, বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ইত্যাদি কারণে রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। মানুষের চলাচলের এ রাস্তাকে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও নিষ্কণ্টক করাই ইসলামের নির্দেশ। তা ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মানুষের একটি স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। এটি সুস্থ মনন ও রুচিবোধের বড় পরিচায়ক। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে দেহমন যেমনিভাবে সুস্থ থাকে, আল্লাহতায়ালাও তাদের প্রতি খুশি থাকেন। তাই ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি যত্নশীল হওয়ার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে বাড়িঘর ও তার আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে। বিশেষভাবে, এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে বলেছে, আমাদের ঘরের ময়লা-আবর্জনা দ্বারা কোনো প্রতিবেশী বা পথচারী যেন কষ্টের শিকার না হয়। কিন্তু তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য হলো, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন। মানুষ ময়লা ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করে না। যার কারণে রাস্তায় দেখা যায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। অনেকে গাড়িতে বা রাস্তার পাশে কলা, আম ইত্যাদি খেয়ে খোসাটা রাস্তায় ফেলে দেয়। এ ছাড়া রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলা, টায়ার জ্বালানো, অহেতুক রাস্তা বন্ধ করা, রাস্তা কেটে রাখা, দোকান বা হোটেল পরিষ্কার করে ময়লা রাস্তায় ফেলা, গ্যারেজ পরিষ্কারের ময়লা পানি রাস্তায় ঢেলে দেয়া, রিজার্ভ পানির ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করে ময়লা পানি রাস্তায় ফেলা, ইট-বালু, সুরকি-পাথর, রড ইত্যাদি বাড়ি নির্মাণসামগ্রী রাস্তায় স্তূপ করে রাখা; ঘরের ধুলাবালি, ময়লা-আবর্জনা ও উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা, মলমূত্র ত্যাগ করা, সিগারেটের প্যাকেট ফেলা, পানের পিক ফেলা, দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন কোনো জিনিস ফেলে রাখা, ছাদ থেকে পানি নিষ্কাশনের পাইপ রাস্তায় দেয়া; এমনকি বাসার ওপর থেকে ময়লা ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তার ওপর ফেলে দিচ্ছি। এতে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, রোগ-জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তা অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিন আছে; কিন্তু সময়মতো ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করাও হয় না। বিশেষ করে, আমাদের সমাজে বা শহরের রাস্তায় নগরবাসীকে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায়। অনেক লোক রাস্তাসংলগ্ন স্থানে মূত্র ত্যাগ করে। ফলে তা ড্রেন গড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। এতে পথচারীদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একটু বৃষ্টি হলে সড়কদ্বীপের নালায় জমা হওয়া প্রস্রাবের উৎকট দুর্গন্ধে হাঁটা যায় না। বৃষ্টির পানি ও নালার পানি একত্রে মিশে অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করে। পথিকের হাঁটতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ পথের ধারে অথবা ফুটপাতে প্র¯্রাব করতে লজ্জাবোধ করেন না। এটি কবিরা গোনাহর পাশাপাশি লজ্জাহীনতা ও অসভ্যতার প্রমাণ বহন করে।

গ্রাম-গঞ্জে রাস্তার পাশে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয় গরুর গোবর। ফলে প্রতিনিয়তই ছড়াচ্ছে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ। দূষিত হচ্ছে সুস্থ পরিবেশ। বাড়ছে রোগ-জীবাণু ও মশার সয়লাব। দিন শেষে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে পথচারী ও প্রতিবেশীর। এগুলো সবই পথ ও পথিকের হকের ব্যাপারে উদাসীনতার প্রমাণ। এসব গর্হিত কাজের মাধ্যমে এভাবে পরিবেশ নষ্ট করা ও জনগণকে কষ্ট দেয়া থেকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।

পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অন্যতম শাখা

কোরআন-সুন্নাহে ঈমানের অনেক শাখা-প্রশাখার কথা এসেছে। ঈমানের পূর্ণতার জন্য সেগুলো নিজের মাঝে ধারণ করতে হবে। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়াও ঈমানের একটি শাখা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরোর্ধŸ কিংবা ষাটোর্ধŸ শাখা রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাখা হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা আর সবচেয়ে সাধারণ শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া।’ (বোখারি : ৯, মুসলিম : ৩৫)। অর্থাৎ ঈমানের ন্যূনতম দাবি, চলার পথে সাধ্যানুযায়ী কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া। এটি আমাদের নাজাতেরও কারণ হয়ে যেতে পারে! পথের কষ্ট বিভিন্নভাবে হতে পারে। চলার পথে কোনো গর্তে পড়ে পা মচকে যেতে পারে। পড়ে থাকা কোনো কাঁটা বা ভাঙা কাঁচের টুকরো কারও পায়ে বিঁধে যেতে পারে। ইটের টুকরা বা শক্ত কোনো কিছুতে কেউ হোঁচটও খেতে পারে। পড়ে থাকা কোনো ফলের খোসা কিংবা পলিথিনে কারও পা পিছলে যেতে পারে। ময়লা-আবর্জনা বা দুর্গন্ধযুক্ত কোনো কিছু পথিকের কষ্টের কারণ হতে পারে। এমনকি দৃষ্টিকটু কোনো বিষয়ও অন্যদের কষ্ট ও বিরক্তির কারণ হতে পারে। তাই ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘কষ্ট দ্বারা উদ্দেশ্য, পাথর, মাটির টুকরো, কাঁটাসহ কষ্টদায়ক সবকিছু।’ (শরহু মুসলিম লিন নববি : ২/৬)।

কষ্টদায়ক জিনিস অপসারণ করা সদকা

অন্যকে দান করে কমবেশি আমরা সদকার সওয়াব লাভ করি। যদিও সেটি সদকার প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিন্তু এর বাইরেও সদকার সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু পথ রাসুল (সা.) আমাদের বাতলে দিয়েছেন। একটি হলো, পথের কষ্ট দূর করা। সদকার মাধ্যমে যেভাবে সদকাণ্ডগ্রহীতার প্রতি উপকার ও কল্যাণ পৌঁছে দেয়া হয়, পথের কষ্ট দূর করা ও পথচারীর নিরাপদ পথচলা সহজ করার মাধ্যমেও আমাদের পক্ষ থেকে পথচারীর প্রতি এক ধরনের কল্যাণ পৌঁছানো হয়। তাই রাসুল (সা.) বলেন, ‘পথের কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেয়া সদকা।’ (মুসলিম : ১০০৯)। অন্য এক হাদিসে নবীজি (সা.) পথের কষ্টদায়ক কিছু বস্তুর নাম ধরে ধরেও বলেছেন, পথ থেকে এগুলো সরিয়ে দেয়া সদকা। যেমন- রাসুল (সা.) আবু জর গিফারি (রা.)-কে বেশকিছু উপদেশ দেন। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল, ‘রাস্তা থেকে পাথর, কাঁটা, হাড্ডি সরানোও তোমার জন্য একটি সদকা।’ (তিরমিজি : ১৯৫৬)।

ক্ষমাপ্রাপ্তির অন্যতম আমল

বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তায় চলতে চলতে একটি কাঁটার ডাল পেল, সে সেটিকে সরিয়ে দিল। আল্লাহ তার এ কাজের কদর করলেন এবং তাকে পাপমুক্ত করে দিলেন।’ (মুসলিম : ৫০৪৯)। অর্থাৎ তেমন বিরাট কোনো আমলের কারণে নয়, বরং মানুষের যাতায়াতের রাস্তায় একটি কাঁটাদার গাছ ছিল, এ ব্যক্তি সেটি কেটে দিয়েছিল। যাতে পথিকের পথচলা নির্বিঘ্নে হয়। এ আমলের বরকতেই আল্লাহ তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিয়েছেন। রাস্তায় চলাচলের সময় অনেক কষ্টদায়ক বস্তু আমাদের নজরে আসে। কিন্তু আমরা মনে করি, এটা তো সরকারের কাজ, তারা করবে। তাদের করা উচিত, কিন্তু আমরা মুসলমান, সুতরাং এটা আমাদেরও দায়িত্ব। কারণ, এটা আমাদের ঈমানের দাবি। শুধু তাই নয়, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরানো পাপমুক্তির মাধ্যম। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় রাস্তায় কাঁটাদার গাছের একটি ডাল পেল। তখন সেটাকে রাস্তা হতে অপসারণ করলে আল্লাহ তার এ কাজকে কবুল করে নিলেন। ফলে তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ (বোখারি : ৬৫২)। এ হাদিসের আলোকে বলা যায়, মোমিনের কাছে ঈমানের ন্যূনতম দাবি হলো, সে যখন রাস্তায় চলবে, কষ্টদায়ক কিছু দেখলে সরিয়ে দেবে। হতে পারে, এ উসিলায় সে কেয়ামতের দিন নাজাত পেয়ে যাবে।

রাস্তা নোংরা করার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি

নবীজি (সা.) তার প্রিয় সাহাবিদের পথের কষ্ট দূর করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কারণ, নিরাপদ পথের প্রয়োজনীয়তা আমাদের সমাজবদ্ধ জীবনে সবার জন্যই অনস্বীকার্য। এর জন্য নবীজি (সা.) যেমন উৎসাহিত করেছেন, অবহেলার জন্য ভীতিও প্রদর্শন করেছেন।

মোমিন তো সে, যার কারণে অন্য কেউ কষ্ট পায় না। মোমিন তো সে, যে অন্যের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করে। অন্যকে আরাম পৌঁছানোর চিন্তা করে। এমনকি আরেক ভাই যেন কষ্টের শিকার না হন, তার জন্য সে নিজেও কষ্ট করতে প্রস্তুত থাকে। এটি মোমিনের আখলাক এবং ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক সময় আমাদের থেকেও এমন কাজ হয়ে যায়, যা কখনও মোমিনের জন্য শোভনীয় নয়। এ ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) ঘৃণিত একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এবং তাকে অভিশাপের কারণ বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুই অভিশাপকারী থেকে তোমরা সতর্ক থাক।’ সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! দুই অভিশাপকারী কী?’ তিনি বললেন, ‘যে মানুষের চলাচলের রাস্তায় অথবা তাদের ছায়া গ্রহণের স্থানে পেশাব-পায়খানা করে।’ (মুসলিম : ২৬৯, সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৪১৫)।