ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবেশবান্ধব সৃষ্টির রহস্য

আবদুল্লাহ নোমান
পরিবেশবান্ধব সৃষ্টির রহস্য

মহান আল্লাহ এ বসুন্ধরাকে সাজিয়েছেন অপরূপ নৈপুণ্যে। সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন নান্দনিক সৌন্দর্যের মনকাড়া নিদর্শন। তিনি নিখিল বিশ্বে অসংখ্য মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে, তৈরি করেছেন নিজস্ব ব্যঞ্জনায়। রূপসী দৃশ্যে চোখ জুড়ানোর জন্য প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন সবুজ শ্যামলিমায়। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য গাছপালা, তরুলতা এবং উদ্ভিদ দিয়ে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছেন সুনিপুণভাবে। রংবেরঙের ফুলের মোহনীয় সুবাসে আমোদিত করে রেখেছেন পুষ্পবীথি। মিষ্টতার আস্বাদনে হৃদয়-মন ভরিয়ে দিতে রেণুর মাঝে সৃষ্টি করেছেন মধুর বিন্দু। আরোগ্যময় স্বাস্থ্যকর মধু সরবরাহে ফুলের মিলনমেলায় পাঠান রসিক ভ্রমর। খাবারের প্রয়োজন মেটাতে, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং বিষণ্ন মনে আনন্দের দোলা দিতে সৃজন করেছেন অসংখ্য পশুপাখি। যেন বান্দা আবেগাপ্লুত হয়ে কৃতজ্ঞ মনে লুটিয়ে পড়ে সেজদায়। জবানে সৃষ্টি হয় ‘আলহামদুলিল্লাহ’র সুমধুর গুঞ্জন। অবচেতন মনে বেজে ওঠে ‘আল্লাহু আকবার’-এর প্রাণময় ধ্বনি। এভাবে করুণাময় রব পৃথিবীর দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছু আমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন তার নিরঙ্কুশ কুদরতে। লাগিয়ে রেখেছেন আমাদের উপকারে অহর্নিশ, যাতে এসব নেয়ামতের বারিধারায় সিক্ত হয়ে প্রকৃত দাতাকে ভুলে না যাই আমরা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেসবকে তাঁর তরফ থেকে তোমাদের উপকারে লাগিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা জাসিয়া : ১৩)।

হাঁস-মুরগির উপকারিতা

আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করা হয়ে থাকে। হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, তেমনি তা আহার করে শরীরে আমিষের অভাবও অনেকাংশে পূরণ করা যায়। কেননা, হাঁস-মুরগির ডিম ও গোশত প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। হাঁসের বিষ্ঠা ভালোমানের জৈব সারও বটে। তা ছাড়া মুক্ত অবস্থায় পালন করলে হাঁস-মুরগিকে তেমন বেশি খাদ্য দেয়ার প্রয়োজন হয় না। হাওর-বিল, ডোবা-নালা ও ধানের জমিতে নিজেরা চরিয়ে খেতে পারে। ফলে প্রাকৃতিক খাবারের অভাব হয় না তাদের। বিচিত্র সব প্রাণী দয়াময় রব সৃষ্টি করেছেন আমাদের বহুবিধ কল্যাণার্থেই। কোরআনুল কারিমে তিনি এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ এক পানি থেকেই সব বিচরণকারী জীব সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ওদের মধ্যে কতক এমন, যা নিজের পেটের ওপর ভর দিয়ে চলে, কতক এমন, যা দুই পায়ের ওপর চলে; আর কতক এমন, যা চলে চার পায়ের ওপর। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন; নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে অবগত।’ (সুরা নুর : ৪৫)।

চতুষ্পদ জন্তুর বহুবিধ উপকারিতা

সন্দেহ নেই, মনোরম এ পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের জন্য আর মানুষ আল্লাহর জন্য। চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর দেয়া হাজারো নেয়ামতের অন্যতম। আকার-আকৃতি, শক্তি-বলে এগুলো মানুষের চেয়ে বহু ক্ষমতাবান; কিন্তু তা সত্ত্বেও রাব্বে কারিম এগুলো মানুষের অধীন করে দিয়েছেন নিজ দয়ায়। মানুষ এগুলোকে নিজ প্রয়োজনে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে থাকে। হালচাষ, পরিবহন, দুগ্ধপান, গোশত সংগ্রহসহ নানা পন্থায় দুর্বল মানুষ এসব সবল প্রাণীর মাধ্যমে উপকৃত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি এগুলো তাদের বশীভূত করে দিয়েছি। এগুলোর কতক তাদের বাহন আর কতগুলো তারা আহার করে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৭২)। চতুষ্পদ জন্তুর বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। এগুলোর দুধ মানবদেহে পুষ্টি জোগায়।

ছোট-বড় সব মানুষের জন্যই যা উপকারী ও পুষ্টিকর। দুধকে বলা হয় সুপার ফুড। ডাক্তারি তথ্যমতে, এটি ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের উৎস। দুধে আছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, চর্বি, ওমেগা থ্রি, ওমেগা সিক্সসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এতে আছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, যা শরীরের জন্য জরুরি। এতে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ আছে, যা মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজন। দুধ শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া দেহের টিস্যু ও কোষ মেরামতের জন্য দারুণ উপকারী। দুধ শরীরকে ভালো ও সুস্থ রাখার পাশাপাশি শরীরে শক্তি জোগান দেয় এবং ক্লান্তি দূর করে। মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। দাঁত ও হাত মজবুত রাখে।

মাংসপেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। কম চর্বিযুক্ত দুধ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখে এবং হজমশক্তি বাড়ায়। বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও।

কখনও কি ভেবে দেখেছি, রক্ত আর গোবরের মাঝখান থেকে নানাবিধ উপকারী নির্ভেজাল সাদা দুধ তৈরি করেন কে? নিশ্চয় আল্লাহ। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই গবাদি পশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। তাদের উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে তোমাদের পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ (সুরা নাহল : ৬৬)।

প্রাণীর গোশত ও চামড়ার উপকারিতা

চতুষ্পদ জন্তুর চামড়া ও পশম থেকেও মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। সাধারণত পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে পোশাক, জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার পশুর চামড়া থেকে জিলাটিন বের করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ওষুধ, প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আধুনিক যুগে পশুর চামড়ায় পাদুকার ব্যবহার করা হয়। এমনকি চতুষ্পদ জন্তুর দাঁত ও হাড় দিয়ে বিভিন্ন আসবাব তৈরি করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য পশু-চামড়ার তাঁবুর ব্যবস্থা করেন, তোমরা ভ্রমণকালে এবং অবস্থানকালে তাকে সহজ মনে করো। আর তিনি তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেন এগুলোর পশম, লোম ও কেশ থেকে ক্ষণস্থায়ী গৃহসামগ্রী ও ব্যবহার্য উপকরণ।’ (সুরা নাহল : ৮০)। জানা কথা, সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে আমিষ জাতীয় খাবারের জুড়ি নেই। হালাল প্রাণীর গোশত এরই অন্তর্ভুক্ত। ডাক্তারি গবেষণায় প্রমাণিত, গরুর গোশতে আছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় নয়টি পুষ্টি উপাদান। তা হলো- প্রোটিন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি-১২, সেলেনিয়াম, আয়রন, রিবোফ্লেভিন, ফসফরাস, নায়াসিন এবং ভিটামিন বি-৬।

শরীরে খনিজের অভাবে সৃষ্ট অসুখণ্ডবিসুখ দূর করতে কাজ করে গরুর গোশত। কারণ, এটি খনিজ লবণের দুর্দান্ত উৎস। তা ছাড়া হাড়, কলিজা, মগজ ইত্যাদি থেকেও মেলে প্রোটিন। এ প্রোটিন থেকে পাওয়া অ্যামাইনো এসিড কাজে লাগে হাড় ও গোশত পেশি ভালো রাখতে। তা ছাড়া এটি জিংকের ঘাটতিও দূর করে। আমাদের সুস্থতার জন্য জিংক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি আমাদের শরীরের কোষ ভালো রাখে এবং বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এ ছাড়া অন্যান্য হালাল প্রাণী যেমন উট, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদিতে রয়েছে বিস্ময়কর নানা উপকারিতা। পৃথিবীর অনেক দেশে মরু কিংবা পাহাড়ি অঞ্চলে পরিবহনের জন্য এখনও চতুষ্পদ জন্তুর ব্যবহার চোখে পড়ে। এতসব উপকারে সমৃদ্ধ প্রাণীকুল সৃষ্টি করেছেন যিনি, আমরা কি মনেপ্রাণে তার শুকরিয়া আদায় করি? বাহারি নেয়ামত ভোগ করে রবের কাছে হাত তুলে কখনও কি বলেছি, দয়াময় রব! প্রাণাধিক ভালোবাসি তোমায়? তিনি বলেন, ‘আল্লাহই তোমাদের আরোহণ ও আহারের জন্য বহু পশু সৃষ্টি করেছেন। তোমরা তা আহার করে থাক এবং এগুলোর ওপর মালামাল বহন করিয়ে থাক।’ (সুরা মোমিন : ৭৯)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত