মানবসভ্যতার একাত্মতা এ ধরার প্রকৃতি। প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের পরিপূরক। প্রকৃতি ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি মানুষ ছাড়াও প্রকৃতি বাঁচে না। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে পারে প্রকৃতি ও মানুষের একাত্মতা। প্রকৃতিকে যখন মানুষ আপন করে নেয়, তখনই মানুষ প্রকৃতির অত্যন্ত নিকটাত্মীয় হয়ে যায়। তবে প্রকৃতি যতটা শান্ত নিবিড় ও নিঃস্বার্থ, মানুষ তার এক টুকরোও নয়। যখনই মানুষ প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় মাতে, বৃক্ষনাশ করে, নদী-সমুদ্রকে দূষণ করে, তখন সে প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে সরে যায়। মানুষ নিজেই মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে, সঙ্গে পৃথিবীরও। প্রকৃতিকে ভালোবাসার অর্থ নিজেকেও ভালোবাসা। ক্ষেত, নদী, বন, পাহাড় ইত্যাদি মানুষের কল্যাণে। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ- যেমন পাহাড়ের ঝরনাধারা, সমুদ্রের ঢেউ, বনরাজির সবুজ মানুষের জীবনে অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ঋতুকালীন গাছগাছালি থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন প্রকারের ফল-ফুল মানুষ পায়। দৃষ্টিনন্দন ফুল যার সুরভিতে মানুষের প্রাণ ভরে যায়।
প্রকৃতি না থাকলে মনুষ্য জীবন সংকটে পড়বে
সুন্দরবনকে পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বলা হয়। এখানকার প্রকৃতির দান নানা বৃক্ষ ও উদ্ভিদে ভরা। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের অহংকার। গাঙ্গেয় মোহনার দ্বীপাঞ্চলের বনভূমি হচ্ছে এ সুন্দরবন। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে প্রতি বছরই অসংখ্য পর্যটক যান সেখানে। দিগন্ত-বিস্তৃত পাহাড়, সমুদ্রের অফুরন্ত জলরাশি প্রকৃতির অপরূপ দান। কখনও কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভারসাম্য হারায়। ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, হ্যারিকেন, বন্যা, ভূমিকম্প, উপকূলীয় ভাঙন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাকৃতিক-বিপর্যয় যেমন মনুষ্য-জীবনহানি, পশুপাখির প্রাণনাশ, ঘর-বাড়ি ধ্বংস, ফসল ও সম্পত্তি নষ্ট ইত্যাদি মানবজাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের গতি স্তব্ধ করে দেয়। তেমনই প্রকৃতিও বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। আবার মনুষ্যসৃষ্ট বা সামাজিকভাবে সৃষ্ট যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদি এবং বিভিন্ন প্রাণী থেকে মনুষ্যদেহে সংক্রমিত ভাইরাসজনিত রোগের বিপর্যয়ে মানবজাতির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এতে প্রকৃতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। মানুষকে এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতেই হবে এবং যথাসম্ভব প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত প্রতিটি মানুষের জীবন, প্রাণী ও পক্ষীকুলের জীবন। প্রকৃতিকে ভালোবাসার অর্থ নিজেকেই ভালোবাসা। প্রকৃতি না থাকলে মনুষ্য জীবন, পশুপাখির জীবন সংকটে পড়বে। প্রকৃতির সবকিছু আহরণ করেই পৃথিবীর জীবকুলের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে হয়। তাই আমাদের উচিত প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া, তাকে বাঁচিয়ে রাখা। প্রকৃতি ভালোভাবে বাঁচলে আমরা তার স্বাদ নিতে পারব, বেঁচে থাকতে পারব পরিপূর্ণভাবে।
এসডিজি বাস্তবায়নে পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাব
প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, দেশ বা জাতির নয়; সমগ্র মানবজাতির। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে বিপন্ন পরিবেশ। মানুষের বসবাস উপযোগী বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ। প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় ভারত ও চীনের পরে বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যদিকে বড় শহরগুলোর মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে রাজধানী ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টের প্রতিবেদনে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণকে ৪ নম্বরে দেখানো হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৫৫ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরী পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা না বাড়ালে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণে পড়বে বাংলাদেশ। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টির লক্ষ্যমাত্রার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। বিশেষভাবে যেসব লক্ষ্যমাত্রা সরাসরি সম্পর্কিত, সেগুলো হলো- এসডিজি-২ : খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির উন্নয়ন ও কৃষির টেকসই উন্নয়ন; এসডিজি-৩ : সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা; এসডিজি-৬ : সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা; এসডিজি-৭ : সবার জন্য জ্বালানি বা বিদ্যুৎ সহজলভ্য করা; এসডিজি-১১ : মানব বসতি ও শহরগুলোকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাখা; এসডিজি-১২ : সম্পদের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার; এসডিজি-১৩ : জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ; এসডিজি-১৪ : টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা; এসডিজি-১৫ : ভূমির টেকসই ব্যবহার; এসডিজি-১৬ : শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ, সবার জন্য ন্যায়বিচার, সব স্তরে কার্যকর, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং এসডিজি-১৭ : টেকসই উন্নয়নের জন্য এসব বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের স্থিতিশীলতা আনা। কাজেই এসডিজির বাস্তবায়নে পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রতিভাত হচ্ছে।
প্রকৃতি দিন দিন ভয়ানক রূপ ধারণ করছে
প্রকৃতি হলো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ও মানুষের লাগামহীন দূষণমূলক কর্মের ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। যে পরিবেশ মানুষকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে নিজের সবটুকু দিয়ে লালন পালন করছে এ সমাজের মানুষকে, অন্যদিকে সে নির্মম মানুষগুলোই নির্বিচারে ধ্বংস করছে প্রকৃতি। যার ফলে প্রকৃতি দিন দিন ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে লাগামহীনভাবে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ দূষণের ফলে জলজ প্রাণীদের জলে থাকতে কষ্ট হয়। কারণ, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় না। উদ্ভিদরা সতেজ থাকতে পারছে না। বন-জঙ্গল অবাধে উজাড় হচ্ছে। ফলে বাসস্থান সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণীগুলো। পরিবেশের বিপর্যয়ের প্রভাবে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, সুনামি, বন্যা, খরা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বেড়েই চলেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর সে কারণে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। এ বিষয়ে ২০০৭ সালের জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে। এর ফলে মালদ্বীপ নামক দেশটি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে। এমনকি বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি চলে যাবে সমুদ্রে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততা ও বাড়ছে বন্যা। মাটির গভীরে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সঙ্কট। ঋতু বৈচিত্র্যের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে।
আমাদের কুকর্মের কারণেই আমাদের ধ্বংস হবে
আমাদের দেশের আবহাওয়া বদলে যাওয়ার খুব সহজ কারণ যদি খুঁজতে যাই, তাহলে দেখতে পাব- বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য, বিশেষ করে ট্যানারি ও রাসায়নিক কারখানার বর্জ্য থেকে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। ফলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্মা, বালু, কর্ণফুলী থেকে শুরু করে সারা দেশের নদীগুলো আজ ভয়ংকর রকমের দূষণের শিকার। ইটের ভাটার ধোঁয়ায় অনেক গ্রামের বাতাস ও ফসলের মাটি দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া অনুন্নত যানবাহন ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার দরুন ঢাকার বাতাসে প্রতিনিয়ত দূষণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে যানবাহনের হর্ন ও মাইকের বিকট শব্দে শব্দদূষণও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিষিদ্ধ পলিথিন পচনশীল নয়; তাই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ফলে যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় ড্রেন, ম্যানহোল বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশকে দূষিত করছে। চাষাবাদের ক্ষেত্রে সাময়িক ফলন বাড়ানোর তাগিদে জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার এবং সেই সঙ্গে রয়েছে কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যাপক প্রয়োগ। এ বিষাক্ত কীটনাশকের ফলে ভূমি ও খাল-বিল-নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছপালা কেটে ফেলা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাওয়া দেশের আবহাওয়া বদলে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রাখছে বলেই অনেকের ধারণা। প্রকৃতির অকৃপণ দান যেন মানুষ দু’হাত ভরে লুট করে নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিও রিক্ত ও বিকৃত হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষ নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিনাশ করছে। পরিবেশ দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চরিত্রও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে বেশিদিন পৃথিবীতে আর টিকতে পারব না। আমাদের কুকর্মের কারণে আমাদের ধ্বংস হবে।
পরিবেশ রক্ষায় সজাগ ও সচেতনতা জরুরি
পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা আরও কমবে। যেমন- প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে তার ব্যবহারও বন্ধ করতে হবে। নতুন প্রজন্ম বেশ ভাবতে শিখেছে। যদিও তারাই কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ নষ্টের জন্য দায়ী, যা তারা সরাসরি বুঝতে পারছে না। আজ সময় এসেছে প্রকৃতির বন্ধু খুঁজে বের করার, অর্থাৎ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর। এ ছাড়া গ্রাম থেকে শহরে সবাইকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে সৃষ্ট পরিবর্তন ও করণীয় সম্পর্কে জানানোর। এ ক্ষেত্রে সারা বছর ও দেশব্যাপী একটি অভিযান পরিচালিত হতে পারে। প্রকৃতির ক্ষতি করে সুন্দর জীবন ধারণ কখনোই সম্ভব নয়। তাই সার্বিক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে, পরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করার ক্ষেত্রে ও বিশ্বব্যাপী গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি সবাইকে জানাতে মিডিয়াকে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোকে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি পরিবেশবান্ধব ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে হবে। দারিদ্র্যবিমোচন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সবাই একই কথা বলে।