চোখ মানবদেহের মহাবিস্ময়
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রায় আট গ্রাম ওজন আর ইঞ্চিখানেক ব্যাসের ক্ষুদ্র মানব ইন্দ্রিয়টির নাম চোখ। ছোট্ট মার্বেলের মতো দেখা গেলেও রাজ্যের বিস্ময়ে ভরা এটি। আমৃত্যু চলমান রেলগাড়ি চোখ। এটি স্রষ্টার অসীম কুদরতের মহানিদর্শন। দয়াময় আল্লাহ আমাদের দুচোখে নিযুক্ত রেখেছেন ২৭ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক; যেন আমরা সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের চোখের রেটিনায় রয়েছে ‘ফটো রিসেপ্টর’ নামে কিছু সংবেদনশীল কোষ; যা ‘রড সেল’ এবং ‘কোণ সেল’ নামে দুভাগে বিভক্ত। ‘রড’ নামের কোষগুলো ভালো কাজ করে আধো অন্ধকারে-সন্ধ্যায় কিংবা চাঁদের ম্লান আলোয়; আর ‘কোণ সেল’-এর কাজ হচ্ছে রং শনাক্ত করা। একটা চোখে ‘রড সেল’ রয়েছে ১৩০ মিলিয়ন কিংবা আরো বেশি। অর্থাৎ প্রায় ১৩ কোটি বা এর চেয়েও অধিক। আর ‘কোণ সেল’ রয়েছে ৭০ লাখ। অতএব, দুচোখে ‘ফটো রিসেপ্টর’-এর মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ কোটি ৪০ লাখ। হতে পারে, এর চেয়েও অধিক। ছোট্ট আঁখিদ্বয়ে লাখো-কোটি শ্রমিক আমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন যে রব, আমরা তার কতটুকু শোকরিয়া আদায় করি? দৃষ্টিশক্তির সদ্ব্যবহারই বা করি কতটুকু? অনলাইনে-অফলাইনে যখন চোখের লাগামহীন অপব্যবহার করি, ভিননারীর দিকে অপলকনেত্রে তাকিয়ে থাকি, তখন রবের অসাধারণ এ নেয়ামত নিয়ে কি একটুও ভাবি? তার রাশি রাশি করুণার কথা কি চিন্তা করি? তাহলে হারাম ইচ্ছেটা জলাঞ্জলি দিয়ে কেন বিজয়ী করতে পারি না আসমানি ভালোবাসাকে? অপাত্রে দৃষ্টি পড়ামাত্র চোখ অবনত করে কেন দিতে পারি না আল্লাহপ্রেমের প্রমাণ? বিশ্বচরাচরের দিক-দিগন্তে যেমন রয়েছে আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ, তেমনি মানুষের শরীরের ভাঁজে ভাঁজেও রয়েছে কুদরতের অবাক করা নিদর্শন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন; স্বয়ং তোমাদের মধ্যেও। সুতরাং তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ (সুরা জারিয়াত : ২০-২১)।
চোখের প্রহরী : রাব্বে কারিম আমাদের যে কোনো আঘাত থেকে নিরাপদ রাখতে আঁখিদ্বয় স্থাপন করেছেন কপাল এবং চোয়ালের দুই হাড্ডির মাঝখানে, অপূর্ব এক সুরঙ্গে। অতিরিক্ত আলোয় যেন কষ্ট না পাই, সেজন্য চোখের ওপর ভ্রু দিয়ে শামিয়ানা টেনে দিয়েছেন; কুদরতি ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন। ধুলোবালি থেকে নিরাপদ রাখতে চোখের ওপর লাগিয়েছেন পলক নামক স্বয়ংক্রিয় পর্দা। এসব একদিকে যেমন চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে, তেমনি সংবেদনশীল এ অঙ্গের জন্য সেইফটি হিসেবে প্রহরীর ভূমিকা পালন করে রবের নির্দেশে। তাছাড়া দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা বৃদ্ধিতে আমাদের চারপাশ ভরে দিয়েছেন সবুজের সমারোহে। বিস্তৃত মাঠজুড়ে বিছিয়ে রেখেছেন চোখজুড়ানো সবুজের গালিচা; যা হৃদয়পাড়ায় জাগিয়ে তোলে অনির্বচনীয় সজীবতার হিন্দোল। এখানে-ওখানে চোখের ভিটামিনসমৃদ্ধ নানা ধরনের শাকসবজি, বিচিত্র স্বাদের ফলমূল অবারিতভাবে দিয়ে রেখেছেন নিজ করুণায়। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে এসব উৎপন্ন করেন আমাদের জন্য। পবিত্র কোরআনের হৃদয়ছোঁয়া বাণী- ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর আমি তার দ্বারা সব রকমের উদ্ভিদ (এর অঙ্কুর) উদ্গত করি। তারপর তা থেকে উদ্গত করি সবুজ গাছ, যা থেকে উদ্গত করি ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা আর খেজুর গাছের মাথি থেকে নির্গত হয় ঝুলন্ত কাদি। (উদ্গত করি) আঙ্গুরের বাগান, যয়তুন ও আনার- পরস্পর সদৃশ ও অসদৃশ। তোমরা লক্ষ্য কর প্রত্যেক গাছের ফলের প্রতি, যখন তা ফলবান হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি। নিশ্চয়ই এসবের মধ্যে ঈমানদারদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আনআম : ৯৯)।
চোখ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান : চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য হলো, মানবদেহে প্রতিদিন প্রায় ১.২ এমএল পানি তৈরি হয়। তবে সে জল নাকের কাছে চোখের পাতার সীমানায় অবস্থিত ছোট গর্তের মধ্য দিয়ে চলে যায়। ফলে বিষয়টি লক্ষ্য করা হয় না। মানুষ যখন দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে কিংবা ভাবে-অনুভবে আবেগাপ্লুত হয়, তখন গড়িয়ে পড়ে আঁখিজল। কখনো ফোঁটায় ফোঁটায়, কখনো অঝোরধারায়। উৎপন্ন জল গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দরদর করে। এ চোখের পানির রয়েছে বিস্ময়কর উপকারিতা। এটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রোধ করে এবং ধ্বংস থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। সেই সঙ্গে চোখের বহিরাংশে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। এছাড়া চোখের জল অক্ষিগোলকে রক্ষা করে শুকনো হওয়ার হাত থেকে। এ সবই সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় মহামহিম রবের কুদরতি নির্দেশনায়। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মানুষের চোখে প্রতি মিনিটে প্রায় ১৫ বার পলক পড়ে। এর মাধ্যমে অক্ষিগোলকের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে জল। এতে চোখ থাকে আর্দ্র এবং ধুলো বা বর্জ্য বেরিয়ে আসে আপনাতেই। আবার শরীরের নানা রোগ ভেসে ওঠে চোখে। ডায়াবেটিসের কারণে কখনো কখনো চোখের রেটিনায় দাগ দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের চোখে রেটিনার ওপর থাকা ধমনী চকচক করতে থাকে। এমন অনেক চিহ্ন ধরা পড়ে চোখে রোগের লক্ষণ হিসেবে। চোখ হৃদয়ের জানালাও বটে। মানুষের আবেগ যেমন প্রকাশ পায় তার নয়নতারায়, তেমনি চোখের গতিতে মনের অবস্থাও অনুমান করা যায়। এছাড়া নানা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা দ্বারস্থ হয় চোখের। তাই আঁখিদ্বয় মানবদেহের এক অপার বিস্ময়। ভাবার বিষয় হলো, আল্লাহর দেয়া অমূল্য এ নেয়ামতের কতটুকু কদর করি আমরা? বিজন অন্ধকারে গভীর রাতে সাদা নীলের অন্ধকার জগতেই কেন হয় আমাদের পথচলা? এ নয়নজোড়া তো অপরাধ জগতের কোনো গডফাদার, নির্লজ্জ কোনো সুপারস্টার আমাদের দেয়নি। দিয়েছেন আমাদের করুণাময় রব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কান-চোখ ও অন্তর; (তবে) তোমরা খুব কমই শোকরিয়া আদায় কর।’ (সুরা মোমিনুন : ৭৮)।
যেভাবে আমরা দেখি : ফটো রিসেপ্টরের সাহায্যেই আমরা যে কোনো বস্তু দেখতে পাই। ফটোরিসেপ্টর হলো চোখের নিউরন; যা আলোর প্রতিক্রিয়াতে ভিজ্যুয়াল সার্কিটকে ঘুরিয়ে দেয়। যা আমাদের দৃষ্টি রাখতে সক্ষম করে। এ ফটোরিসেপ্টর নষ্ট হলে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন বা চোখের অন্য রোগ হয়। যাতে অপরিবর্তনীয় অন্ধত্ব সৃষ্টি করে। নেত্রপল্লব খোলা থাকার সময় বস্তু থেকে নির্গত আলোকরশ্মি ক্রমান্বয়ে কর্নিয়া, অ্যাকুয়াস হিউমার, পিউপিল ও ভিটয়াসের মধ্য দিয়ে রেটিনায় প্রবেশ করে ফটো রিসেপ্টরের কাছে চলে যায়। আর ফটো রিসেপ্টর তা প্রসেসিং করে অপটিক নার্ভে (চক্ষুবিষয়ক স্নায়ু) পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ইলেকট্রনিক ইম্পালসো (বৈদ্যুতিক ধাক্কা) মাধ্যমে তা আমাদের ব্রেনের প্রদর্শনী কেন্দ্রে চলে যায়। এরপর আমরা প্রতিটি বস্তু ঠিকঠাক দেখতে পাই। অবলোকন করি প্রত্যেকটি জিনিসের রং, পরিমাণ, অবকাঠামো ইত্যাদি। কত সুন্দর মেকানিজম মহান সৃষ্টিকর্তার, ভেবে দেখেছি কখনো? আর হ্যাঁ, ‘অপটিক নার্ভ’ অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চিকন হওয়া সত্ত্বেও এতে ৭ লাখ থেকে ১৭ লাখ পর্যন্ত ফাইভার (তারের মতো খুবই সুক্ষ্ম পদার্থ) রয়েছে। আল্লাহর অসাধারণ এ নেয়ামত আমরা ভোগ করছি অহর্নিশ। এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছি অনুক্ষণ। তিনি আমাদের দৃষ্টিশক্তির নেয়ামতে ধন্য করেছেন নিজ করুণায়। যেন এর সদ্ব্যবহারে আমাদের জীবন হয়ে ওঠে ঈমানি আবেশে প্রাণময়; ধর্মীয় ভাবাবেগে মধুময়। অথচ আমরা নেয়ামতদাতাকে ভুলে মৌজ-মাস্তিতে লিপ্ত। দিনরাত তার নাফরমানিতে ব্যস্ত। করুণাময় আল্লাহ কত মায়াঝরা কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি কি তাকে দিইনি দুটি চোখ এবং একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট? আর আমি তাকে উভয় পথ (কল্যাণ ও অকল্যাণের) দেখিয়ে দিয়েছি।’ (সুরা বালাদ : ৮-১০)।
চোখের মূল্য বুঝতে হলে : মানুষ যে বস্তু না চাইতেই পেয়ে যায়, বিনাশ্রমেই তার করায়ত্বে আসে, তার যথাযথ মূল্যায়ন করে না। হারানোর পরেই এর প্রকৃত মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আমরা প্রতিনিয়ত দৃষ্টিশক্তির অমূল্য এ নেয়ামত ফ্রিতে ভোগ করছি। যদি আল্লাহতায়ালা চোখ ব্যবহারের দৈনিক বা মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করতেন, তাহলে কিছুটা হলেও উপলব্ধি হতো এর মূল্য। দৃষ্টিশক্তি দয়াময়ের কত বড় নেয়ামত, তা সামান্য হলেও অনুভব করতে হলে হাত দিয়ে চোখদুটো চেপে ধরে একটু কল্পনা করতে হবে। (আল্লাহ না করুন) কেউ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শত চেষ্টা করেও এ সুন্দর পৃথিবীটা অবলোকন করতে পারছে না। দেখতে পাচ্ছে না নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী, আদরের সন্তানাদি এবং রক্তের বাঁধন পিতামাতাকে। অন্যের সাহায্য ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না প্রয়োজনীয় চলাফেরা, ওঠাবসা, পানাহার। কতক্ষণ এ অবস্থায় থাকা যায়! হাত সরিয়ে ফেলুন। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় সেজদায় লুটিয়ে পড়ুন। সেই সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করুন চোখের অপব্যবহার না করার, অপাত্রে দৃষ্টি না ফেলার। আল্লাহ না করুন, আমাদের নাফরমানির কারণে যদি আমাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন, এমন কার ক্ষমতা আছে, যে আমাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবে! জীবনের সব অর্জন এবং সম্পদ দিয়েও কি তা ফেরত পাওয়া যাবে? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি বলুন, বল তো যদি আল্লাহ তোমাদের কান ও চোখগুলো ছিনিয়ে নেন এবং তোমাদের অন্তরে মোহর করে দেন, তবে আল্লাহ ছাড়া এমন মাবুদ আর কে আছে, যে তোমাদের এসব এনে দেবে? দেখুন, আমি কিরূপে নানাভাবে আয়াতসমূহ বর্ণনা করি। তারপরও ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সুরা আনআম : ৪৬)।
যদি দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়া হয় : চোখ শারীরিক অঙ্গ হিসেবে যেমন খুবই স্পর্শকাতর; যার সামান্য আঘাতই ডেকে আনতে পারে চরম বিপর্যয়, তেমনি দৃষ্টিশক্তির অপব্যবহারও অত্যন্ত বিপজ্জনক; যার বিষক্রিয়ায় নাশ হতে পারে মানুষের রঙিন জীবন। বস্তুত চোখের শারীরিক অসুস্থতা মানুষকে নিয়ে যায় হাসপাতালের করিডোরে কিংবা সর্বোচ্চ কবরজগতে। আর দৃষ্টিশক্তির আত্মিক ব্যাধি মানুষকে নিক্ষেপ করে জাহান্নামের ভয়াল গহ্বরে, আগুনের অসহনীয় শাস্তিতে। কারো দৃষ্টিশক্তি যদি নষ্ট হয়ে যায়, আর আল্লাহ যদি এ শর্তে তাকে দৃষ্টিশক্তি দান করেন, ‘নন মাহরাম’ নারীর দিকে তাকাতে পারবে না। যদি তাকাও, তোমার দৃষ্টিশক্তি চিরতরে ছিনিয়ে নেয়া হবে। তাহলে সেই ব্যক্তি কি এ শর্ত মেনে নেবে না অম্লান বদনে? ঘরে-বাইরে, অনলাইনে-অফলাইনে কোথাও কি সে অসংযত দৃষ্টি ফেলবে? পর্নোগ্রাফির অন্ধকার জগতে উঁকি মারার সাহস করবে কখনো? তখন যে সে দেখতে পাবে না কখনো ফলে-ফুলে সুশোভিত সবুজাভ এ পৃথিবী! চোখের খেয়ানতের কারণে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে সে দৃষ্টিশক্তির অমূল্য নেয়ামত। আল্লাহ না করুন, আমার-আপনার ক্ষেত্রে বাস্তবেও যদি এমনটা ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি কেমন বিভীষিকাময় হতে পারে! কেউ যখন নির্জনে অশ্লীল ভিডিওতে বুঁদ হয়ে থাকে, রব চাইলে তখন দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ইচ্ছা করলে ওদের চোখগুলো বিলোপ করে দিতে পারি। অনন্তর ওরা পথের দিকে দৌড় দিতে চাইবে। কিন্তু দেখবে কেমন করে?’ (সুরা ইয়াসিন : ৬৬)।