ইসলামে পোশাকের গুরুত্ব
মুফতি সফিউল্লাহ
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম ধর্মে পোশাকের গুরুত্ব সীমাহীন। পোশাকের মাধ্যমে ইসলামি ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটে। পোশাক ব্যক্তিত্বের পরিচয় ফুটিয়ে তোলে। পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের স্বভাব-প্রকৃতি অনুভব করা যায়। পোশাক মানুষকে সম্মানিত করার পাশাপাশি যথাযথভাবে পোশাকের গুরুত্ব না দিলে ব্যক্তিত্বকে কলুষিত করে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়েও ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে। পোশাককে আরবিতে ‘লেবাস’ বলা হয়। এর অর্থ- পরিহিত বস্তু বা যা পরিধান করা হয়। শরিয়তের পরিভাষায় লেবাস ও পোশাক বলা হয়, যা মানুষের লজ্জাস্থানকে আবৃত করে। (ফতোয়ায়ে শামি : ৬/৩৫২)। পোশাক মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়। লজ্জাস্থান আবৃত রাখা এবং সুন্দর ও পরিপাটি থাকার চাহিদা মানুষের স্বভাবজাত। তদ্রূপ শীত-গ্রীষ্মের প্রকোপ ও বাইরের ধুলোবালি থেকে শরীরকে রক্ষার জন্য তা অতীব জরুরি আবরণ।
পোশাক আল্লাহর অপার অনুগ্রহ
পোশাক মানুষের জন্য আল্লাহর অপার এক অনুগ্রহ। আদিকাল থেকে মানুষ পোশাকের ব্যবহার করে আসছে। মানুষের রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে পোশাকের মধ্য দিয়ে। তাই পোশাক পরিধানে যথাযথ বিধিনিষেধ পালনের গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে বনি আদম! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবর্তীণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবর্তীণ করেছি সাজসজ্জার বস্ত্র ও পরহেজগারির পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।’ (সুরা আরাফ : ২৬)। ইসলাম পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়ে নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যা অনুসরণ করে মানুষ পোষাকের কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং পোষাকের অকল্যাণ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
এ ধরনের কিছু নীতিমালা হলো-
সতর আবৃত করা
লেবাস অবশ্যই সতর আবৃতকারী হতে হবে। ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজে সতর ঢাকা ফরজ। পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর মুখমণ্ডল, পা, কব্জি ও হাত ছাড়া গোটা শরীর নামাজে আবৃত রাখা ফরজ। তদ্রূপ গাইরে মাহরাম ও পরপুরুষের সামনে মুখমণ্ডলসহ গোটা শরীর আবৃত রাখাও জরুরি। অতএব, পোশাকের মাধ্যমে যাতে এ প্রয়োজন পূরণ হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য। এত সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধান করা যে, সতর বা সতরের কিছু অংশ খোলা থাকে বা এত পাতলা কাপড় ব্যবহার করা যে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়, নারী-পুরুষ সবার জন্যই হারাম ও নিষিদ্ধ। তদ্রূপ এত আঁটসাঁট পোশাক, যার ওপর দিয়ে শরীরের আবরণীয় অঙ্গসমূহ ফুটে ওঠে, তাও বর্জনীয়।
অন্যের সাদৃশ্য বর্জন করা
পোশাক-পরিচ্ছদে দুটি বিষয়ে সাদৃশ্য অবলম্বনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে- এক. কাফের-মুশরিকদের পোশাক গ্রহণ করা যাবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৩৩)। দুই. বিপরীত লিঙ্গের মতো পোশাক ধারণ করা যাবে না। অর্থাৎ পুরুষের জন্য নারীদের মতো আর নারীদের জন্য পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করা জায়েজ নয়। ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কে লজ্জা ও শালীনতা রক্ষাকারী পোশাক পরিধান করার নির্দেশ দিলেও পোশাকের ক্ষেত্রে উভয়কে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে অত্যন্ত কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) নারীর বেশধারণকারী পুরুষের ওপর আর পুরুষের বেশধারণকারিনী নারীর ওপর লানত করেছেন। (বোখারি : ৩৮৮৫)।
রেশমের পোশাক পরিধান না করা
ইসলামে রেশমের পোষাক পুরুষের জন্য নিষেধ, কিন্তু নারীর জন্য অনুমোদিত। সোনার ব্যবহার নারীর জন্য জায়েজ, কিন্তু পুরুষের জন্য হারাম। যে কোনো রংয়ের কাপড় নারীরা পরিধান করতে পারে, কিন্তু পুরুষের জন্য কিছু কিছু রং অপছন্দনীয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য রেশমি কাপড় এবং সোনা ব্যবহার করা হারাম; কিন্তু নারীদের জন্য তা হালাল।’ (তিরমিজি : ১৭২০)।
পুরুষ লাল-জাফরান ও হলুদ পরবে না
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি লাল রঙের জিনপোষে সওয়ার হই না, হলুদ (কুসুম) বর্ণের কাপড় পরি না এবং রেশম আটকানো জামা পরিধান করি না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৪৮)। রাসুল (সা.) যেহেতু নিষেধ করেছেন, সেহেতু অবিমিশ্র উজ্জ্বল লাল ও হলুদ উভয় রংয়ের পোশাক পুরুষদের জন্য না পরাই উত্তম। ইমাম নববি (রহ.) তার আল মাজমুতে উল্লেখ করেছেন, তবে লাল ও হলুদের সঙ্গে অন্য রঙ মিশ্রিত থাকলে উক্ত পোশাক পরায় কোনো বাধা নেই।
অহঙ্কার ও লোক দেখানোর মানসিকতা বর্জন
পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে যেন অহঙ্কার মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়েও হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না, (রাগান্বিত থাকবেন)।’ (বোখারি : ৫৭৯১)। মানুষকে দেখানোর জন্য বা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুব জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক বা ব্যতিক্রমী পোশাক পরিধান করাও শরিয়তে নিষেধ। এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধির (উদ্দেশ্যে) পোশাক পরিধান করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরিধান করাবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০২৩)।
পোশাক পরিষ্কার ও পরিপাটি হতে হবে
পোশাক সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। তিনি বলেন, ‘হে বনি আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে, আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)। রাসুল (সা.) পোশাক পরিষ্কার ও পরিপাটি হওয়ার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। জাবের (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাদের কাছে এলেন। এক ব্যক্তির মাথার চুল এলোমেলো দেখলেন। তখন তিনি বললেন, ‘এই লোকের কি এমন কিছু নেই, যা দিয়ে সে তার মাথা পরিপাটি করবে?’ অপর এক ব্যক্তিকে ময়লা কাপড় পরিহিত দেখে বললেন, ‘এর কাছে কি এমন কিছু নেই, যা দিয়ে তার কাপড় ধৌত করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৫৬)।
অপচয় থেকে বিরত থাকতে হবে
বিলাসিতার জন্য কিংবা শুধু শখের বসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পোশাক ক্রয় করা ইসলামে নিষেধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বনি আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে, আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।
পোশাকের ব্যাপারে অপচয় করা যেমন নিন্দনীয়, তদ্রূপ কৃপণতাও কাম্য নয়। প্রয়োজন ও সামর্থ্যরে মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে লেবাস-পোশাক ব্যবহার করাই ইসলামের নির্দেশনা। এক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর দরবারে নিম্নমানের পোশাক পরিধান করে উপস্থিত হন। এটা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার কি অর্থকড়ি, সহায়-সম্পত্তি নেই?’ সাহাবি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে তো আল্লাহ অঢেল সম্পত্তি দান করেছেন।’ তখন রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর দেয়া সম্পদ তোমার শরীরে দৃশ্যমান হওয়া উচিত।’ (তাবারানি কাবির : ১৯/৯৭৯)।
পোশাক পরে আল্লাহর শোকরগোজারি
পোশাক যেহেতু আল্লাহতায়ালার নেয়ামত, তাই তা পরিধান করে শোকরিয়া আদায় করা উচিত। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন কোনো নতুন কাপড় পরিধান করতেন, তখন বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমারই প্রশংসা। তুমিই আমাকে এ পোশাক পরিয়েছ। আমরা তোমার কাছে এ কাপড়ের কল্যাণ ও উপকারিতা প্রার্থনা করি। এর অকল্যাণ ও অপকারিতা থেকে পানাহ চাই।’ (তিরমিজি : ১৭৬৭)।