অপরূপ বাংলাদেশ
হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এই বাংলাদেশ। অপরূপা এ দেশের সবুজ বন-বনানী, সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনরাজি, নদনদী, শ্যামল পাহাড়, বিস্তীর্ণ সমুদসৈকত, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ পিপাসু উৎসাহী মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই রূপমুগ্ধ, বিস্ময়-পুলকিত কবি তার আবেগ-স্নিগ্ধ উচ্চারণে বাংলাকে বলেছেন ‘রূপসী বাংলা’। ছয় ঋতুর দেশ এ রূপসী বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল দেশটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মিউজিয়াম। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির জন্য এর প্রশংসা যুগ যুগ ধরে কবিদের বাণীতে উচ্চারিত হয়েছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। এজন্য বাংলাদেশের জলবায়ু মোটামুটি সমভাবাপন্ন। মৌসুমি বায়ুর প্রভাব দেশের জলবায়ুর ওপর এত বেশি যে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঋতুতে জলবায়ুর কিছুটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালীন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ দেশের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ২০৩ সেন্টিমিটার। পশ্চিমাংশ অপেক্ষা পূর্বাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশের মোট বৃষ্টিপাতের পাঁচভাগের চারভাগই বর্ষাকালে হয়ে থাকে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব শুকনো মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের উত্তরে ভাওয়াল ও মধুপুর গড়। গেরুয়া রঙের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গজারি গাছ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবন। পূর্বে পাহাড়ের কোলঘেঁষে সাজানো চা-বাগান। এরই মাঝে বিশাল সব ছায়াবৃক্ষ। পশ্চিমে ধু-ধু প্রান্তর। প্রকৃতির রুক্ষতার মাঝেও এখানে দেখা যায় সারি সারি আম্রকানন, আখের খেত কিংবা পানের বরজ। বাংলাদেশের সুন্দরবন সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত। কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈকত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকাজুড়ে সীমাহীন সৌন্দর্যের সমাবেশ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে আদিবাসীদের বসবাস। হাতেগোনা শহরগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। গ্রামের সৌন্দর্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু মাঠ আর মাঠ। প্রকৃতিগত অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী দেশ বলা যায়।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট-বড় অসংখ্য নদী এ দেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। প্রতিবছর বন্যায় এ নদীগুলো পলিমাটি বহন করে। এ কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল পলিমাটি দিয়ে গঠিত। পলি মাটির উর্বরতার কারণে এ দেশে ভালো ফসল জন্মায়। এ দেশের প্রায় অধিকাংশ অঞ্চলে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত। এ দেশের ওপর দিয়ে ক্রান্তীয় মৌসুমি বায়ু বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। এ দেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি শীত ও এপ্রিল-মে মাসে গরম বেশি থাকে। তবে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের কারণে যেভাবে সমস্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মৌসুমি বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে বছরের অধিকাংশ সময়ই প্রবাহিত হয়। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মকালে এ দেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে। ফলে গ্রীষ্মের শেষে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর মানচিত্রে এশিয়ার ছোট্ট, সবুজ ভূমি বাংলাদেশ। এর নদী-নালা, খাল-বিল, এর পাহাড়-টিলা, বন-বনানী, এর সমতল ভূমি মিলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারোহ। প্রকৃতির রূপসী কন্যা আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। বারো মাসে ছয় ঋতুর এ দেশে প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমন করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। সারাটি বছর নব নব রূপের মধ্যে আমাদের বসবাস। প্রকৃতি পাল্টায়। আকাশ রং বদলায়। আমাদের মনের আকাশেও লাগে তার ছোঁয়া। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের নিয়ত লীলা এর নিসর্গকে দিয়েছে বিচিত্র বিভূতি। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ, ছাতিমের স্নিগ্ধ ছায়া, নদীর নীলাভ গহ্বর থেকে জেগে ওঠা বালুচরে খেয়ালি দুপুরে হঠাৎ হাওয়ার মাতম গ্রীষ্মের এ দেশে বর্ষায় একেবারে ভিন্ন রকম। শুধু কুলছাপানো কালো জল, শুধু সারা দিন সারারাত গলে পড়ে আকাশ। গ্রীষ্মের বুকফাটা বাংলাদেশ বর্ষায় ফিরে পায় অকূল যৌবন। আসে শরৎ, ধীর, সজল, লাবণ্যময়। তার সাদা কাশফুল, স্বচ্ছ নীল আকাশে উড়ে যাওয়া বলাকার সারি আর রাতভর অবিরাম, অকৃপণ নীলিমা তার পেয়ালা থেকে ঢেলে দেয় জোছনার সফেদ স্নিগ্ধতা। হেমন্তে পাকে ধান। বাংলাদেশের মুখে তখন মাতৃত্বের মহিমা। এর মধ্যে ঘাসের বুকে জমে ওঠে শিশির। শীত আসে। পাতা ঝরে। ভোরের বাঁকা রোদে ঘাসের ডগায় লেগে থাকা অসংখ্য শিশির কণায় ঝলমল করে লক্ষ-কোটি বাংলাদেশ।
তারপর বসন্ত হাওয়া বয় দক্ষিণে। ফুলে ওঠে নৌকার পাল। বৃক্ষের বাকল চিরে বেরিয়ে আসে পাতা। রোদে তা পান্নার মতোই ঝলমল করে। রিপ ভ্যান উইঙ্কল-এর মতে, ‘এ দেশ যেন গাঢ় শীতার্ত রাতের দীর্ঘ সুপ্তি থেকে জেগে ওঠে।’ কড়ি ও কোমলে বাঁধা এর জলবায়ু, এর প্রকৃতি। যেমন প্রকৃতি, তেমনি সাহিত্য আর সংস্কৃতি। হেমন্তের ধানী রং উদাস অন্তরাগে যে মাঝি নদীজলে ভাসায় ডিঙি, দূর অচেনা গায়ে কোনোদিন না পাওয়া কলসি কাঁখের বধূটির জন্য, গলায় তোলে সুর; বর্ষায় খরস্্েরাতা নদীতে দক্ষ হাতে সে-ই ধরে হাল।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল সব মিলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারোহ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, আড়িয়াল খাঁ, কর্নফুলী আর বুড়িগঙ্গা; যার বুকে ভেসে থাকা রংবেরঙের পাল তোলা সারি সারি নৌকার অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন রূপ বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো মোহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জজুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওড়সহ অসংখ্য হাওড়-বাওড় এ দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগোচর হয় সবুজের সমারোহ। সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয়, এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা সবুজ শ্যামলিমা যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলোড়িত হয়, তখন মনে হয়, সবুজ উর্মিমালা বুঝি ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে।
হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গড়া এ দেশ। এ দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এর রূপ-মাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ ও বসন্ত বরণের মতো অনুষ্ঠানগুলো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলো রং, রূপ ও বৈচিত্র্যে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ এগুলো ভিন্ন ও রোমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। ফলে সুপ্ত মনের পাতায় পাতায়, মনের অজান্তেই আমরা এঁকে যাই প্রকৃতির ছবি; লিখি কবিতা; গেয়ে উঠি গান। মন হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়। বাংলাদেশের প্রকৃতি কখনও কখনও ধ্বংসাত্মকরূপে আবির্ভূত হয়। গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ ও বিবর্ণ হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড তাপে হারিয়ে যায় সবুজ প্রকৃতির অপরূপ শ্যামল শোভা। ফেটে চৌচির হয়ে যায় ফসলের মাঠ। শুকিয়ে যায় নদী। চারিদিকে ছড়ায় ধু-ধু হাহাকার। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে হাজির হয় কালবৈশাখি। এটি উড়িয়ে নিয়ে যায় আমাদের বাড়িঘর। ভেঙে ফেলে গাছপালা। প্রচণ্ড গরমে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। মানুষ তখন চাতক পাখির ন্যায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। বর্ষাকালেও প্রকৃতি মাঝে মাঝে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। বন্যা, জলোচ্ছাসের ফলে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। উপকূলবর্তী মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি সব সময় বৈরী আচরণ করে। জলোচ্ছাসের সঙ্গে তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। অতিরিক্ত বন্যায় গবাদি পশুর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। শীতকালে আমাদের দেশের গরিব মানুষদের দুঃখের সীমা থাকে না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষদের বেশি শীতের কষ্ট সহ্য করতে হয়। শীতে বৃদ্ধ ও শিশুদের বেশি কষ্ট হয়ে থাকে। নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় কাটাতে হয়।
বাংলাদেশের প্রকৃতির ন্যায় এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। প্রকৃতিই বাংলাদেশকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু তাদের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে বাংলার প্রকৃতিকে। এর প্রভাব বাঙালির হৃদয়েও পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতি এ দেশের মানুষের মনকে নানা রঙের আল্পনায় বিচিত্র অনুভবে রঙিন করে তোলে। প্রকৃতির কল্যাণেই আমরা বাংলাদেশে চিরকাল সুখ, সৌন্দর্য ও শান্তি অনুভব করি।