ইসলামি ভাবনায় প্রকৃতি
ড. রাগিব সারজানি
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুসলমানরা মৌলিক চিন্তা ও দর্শন আহরণ করে কোরআনুল কারিম ও নবীজির সুন্নাহ থেকে; যা তাদের পরিচয় করিয়ে দেয় নিজেদের সঙ্গে, চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে এবং এ পৃথিবীতে তারা কী গুরুত্ব বহন করে, তার সঙ্গে। আরো পরিচয় করিয়ে দেয় এ জীবনের সমাপ্তি ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সঙ্গে। মুসলমানদের জন্য তাদের ইসলামের দাবির কারণেই আল কোরআনুল কারিম ও বিশুদ্ধ নববী সুন্নাহে বর্ণিত প্রতিটি বিষয়ের ওপর ঈমান রাখা আবশ্যক। কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই তারা অনুপ্রেরণা ও পরিতৃপ্তি লাভ করবেন। তাদের সব কাজ ও আচরণের ভিত্তিও হবে কোরআন ও সুন্নাহ। কোরআনের আয়াত ও নবীজি (সা.)-এর হাদিস মুসলমানদের প্রকৃতি ও চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে এবং পৃথিবীর বায়ু, পানি, উদ্ভিদ, প্রাণীকুল ও জড়বস্তুর সঙ্গে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখলে মুসলিমণ্ডমানস কীভাবে তার চারপাশের পৃথিবীকে দেখে, তা বোঝা যায়।
প্রথমত : আল্লাহর সৃষ্টি : এ বিস্তৃত অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীর সবকিছু মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। আল্লাহতায়ালাই মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাকে সুঠাম করেছেন এবং তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দিয়েছেন। সুতরাং, মানুষ এবং তার চারপাশে যা কিছু রয়েছে, সবই এক ও অদ্বিতীয় রবের অভিপ্রায় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনি যথাযথভাবে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; তারা যা শরিক করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে। তিনি শুক্র থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। অথচ দেখ, সে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী! তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে। তা থেকে তোমরা আহার করে থাক।’ (সুরা নাহল : ৩-৫)। আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে এবং যা কিছু আছে এ দুটির মধ্যবর্তী স্থানে, বরং পৃথিবীর নিচে যা রয়েছে, সব এক আল্লাহর মালিকানা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যা আছে আকাশমণ্ডলীতে, পৃথিবীতে, এ দুইয়ের অন্তবর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে, তা তাঁরই।’ (সুরা তহা : ৬)।
এসব কারণে প্রকৃতির প্রতি মুসলমানদের অবস্থান হলো পরিচিতি ও বন্ধুত্বের অবস্থান; ভীতি ও শত্রুতার অবস্থান নয়। কেন না, মানবিক শক্তি ও প্রাকৃতিক শক্তি দুটিই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা ও অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত হয়েছে। দুটিই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। কর্মকাণ্ড ও জীবন চলার পথে এ দুটি শক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি অপরটির সহায়ক। মুসলমানরা তাদের আকিদা-বিশ্বাস থেকে এ বার্তা ও প্রেরণা পান যে, তাদের প্রতিপালক আল্লাহ এসব শক্তি সৃষ্টি করেছেন; যাতে পারস্পরিক বন্ধু, সহযোগী ও সহায়ক হয়। এ বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা অর্জনের পথ হলো, এসব শক্তি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা, তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের সহযোগিতা করা এবং একসঙ্গে সবার প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার প্রতি ধাবিত হওয়া। (তাফসির ফি যিলালিল কোরআন : ১/২৫)।
পৃথিবীর ওপর এ বিস্তৃত ভূপৃষ্ঠ এক ও অদ্বিতীয় ইলাহর অভিপ্রায় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মৌলিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা মানুষের সঙ্গে শরিক। আর এ ইলাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে তা মুসলমানদের সঙ্গে শরিক। কারণ, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সব আল্লাহর প্রতি বিনীত, আল্লাহর প্রতি অনুগত। আল্লাহতায়ালা যেমন বলেছেন, ‘তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জবিশেষ। অনন্তর তিনি একে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আসো ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম অনুগত হয়ে।’ (সুরা হা-মিম সাজদা : ১১)। নিখিলবিশ্বের সবকিছু আল্লাহতায়ালার উদ্দেশে সেজদাবনত হয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সেজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে। আবার অনেকের প্রতি অবধারিত হয়েছে শাস্তি। আল্লাহ যাকে হেয় করেন, তার সম্মানদাতা কেউ নেই। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’ (সুরা হজ : ১৮)।
সুউচ্চ ওই আকাশমণ্ডলী ও বিস্তৃত এ পৃথিবী এবং তারা ধারণ করে আছে যত বস্তু ও মাখলুক সবাই মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সপ্ত আকাশ, পৃথিবী ও তাদের অন্তবর্তী সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন কিছু নেই, যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয় তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ৪৪)। মুসলমানদের আবেগ-উপলব্ধিতে বিরাজমান এ দর্শনকে কেন্দ্র করেই তারা পরস্পরিক বন্ধু ও সহযোগী; উভয়ে বিনয়, নম্রতা ও আনুগত্যের সঙ্গে এক আল্লাহর প্রতি ধাবমান।
দ্বিতীয়ত : তারাও তোমাদের মতো উম্মত : মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, তাদের চারপাশে যে সৃষ্টিজগৎ রয়েছে, তারাও মানুষের মতো একেকটি উম্মত। ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল জীবজন্তু, আকাশে উড্ডয়নশীল পাখপাখালি সেগুলোও একেকটি জগৎ; যা মানুষের জগতের সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোনো পাখি ওড়ে না, কিন্তু তারা তো তোমাদের মতো একেকটি উম্মত। কিতাবে কোনো কিছুই আমি বাদ দিইনি; অতঃপর নিজ প্রতিপালকের দিকে তাদের একত্র করা হবে।’ (সুরা আনআম : ৩৮)। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘এ আয়াতের মর্মার্থ হলো- সৃষ্টি, রিজিক, পানাহার ও পার্থিব নিয়তি নির্ধারণে তারাও আমাদের মতোই একেকটি উম্মত। সেগুলোকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। সেগুলোও আল্লাহর ইবাদতকারী, আল্লাহর অনুগত। সেগুলোরও জন্ম ও মৃত্যু এবং রিজিক নির্ধারিত আছে। তাদের পরিণতিও নির্ধারিত।’ (শিফাউল আলিল ফি মাসাইলিল কাজাই ওয়াল কদরি ওয়াল হিকমাতি ওয়াত তা’লিল : ৪১)।
ইমাম কুরতুবি তার তাফসিরে বলেছেন, ‘তারা তোমাদের মতো একেকটি দল, যেহেতু আল্লাহতায়ালাই তাদের সৃষ্টি করেছেন, তাদের রিজিক দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং তাদের ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গত পন্থা নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং তোমাদের উচিত নয়, তাদের ওপর অত্যাচার করা এবং তাদের ব্যাপারে তোমরা যা কিছুর আদিষ্ট হয়েছ, তাতে সীমালঙ্ঘন করা। (আল জামিউ লি আহকামিল কোরআন : ৬/৪১৯)। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির ও চারপাশের পৃথিবীর যে বন্ধন, সে ব্যাপারে ইসলামে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সারমর্ম হলো- মানুষের চারপাশে যে জীবজগৎ ও জড়জগৎ রয়েছে, তাদের সঙ্গে ভালোবাসা ও মমত্বের সম্পর্ক তৈরি করা। কারণ, পশু ও পাখির যত জগৎ রয়েছে, সেগুলোকে মুসলমানরা আমাদের মতোই উম্মত বিবেচনা করে। (রিআয়াতুল বাইয়্যিয়াহ ফি শরিআতিল ইসলাম : ২৯)।
তৃতীয়ত : প্রতিটি সৃষ্টি নির্ধারিত পরিমাপে : এ পৃথিবী এবং তাতে যত মাখলুক রয়েছে, যত বিস্ময়কর সৃষ্টি রয়েছে, তা আল্লাহর কুদরতের সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল। তিনিই এ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা মুশরিকদের ও ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে এ দলিলের দ্বারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ হলো আল্লাহর সৃষ্টি। তাহলে তোমরা আমাকে দেখাও আল্লাহ ছাড়া যারা রয়েছে, তারা কী সৃষ্টি করেছে? বরং জালেমরা রয়েছে সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে।’ (সুরা লোকমান : ১১)। সৃষ্টির প্রাচুর্য ও নানা প্রকারভেদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সূক্ষ্ম ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য। যেখানে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতিটি জগৎ সুশৃঙ্খলভাবে স্থিতিশীল। আল্লাহতাআলা আমাদের জানাচ্ছেন, এ বিপুল সৃষ্টি অতি যত্নে ও নির্ধারিত পরিমাপের সঙ্গে সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।’ (সুরা কমার : ৪৯)।
আয়াতে বর্ণিত ‘নির্ধারিত পরিমাপ’-এর অর্থ হলো, সত্তা ও গুণাবলির ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাপ। আবু হাইয়ান তার তাফসির গ্রন্থে বলেছেন, আল্লাহতায়ালা যত কিছু সৃষ্টি করেছেন, তা প্রকার ও গোত্র এবং বৈশিষ্ট্যাবলির বিচারে নির্ধারিত পরিমাপের। যেমন- উদ্ভিদজগৎ একটি ভারসাম্যপূর্ণ জগৎ। (এখানে প্রতিটি পর্বের ও গোত্রের উদ্ভিদ নিজেদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে)। আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি; আমি তাতে প্রত্যেক বস্তু উদ্গত করেছি সুপরিমিতভাবে।’ (সুরা হিজর : ১৯)। আল্লাহতায়ালা একইভাবে প্রাণীজগৎকেও ভারসাম্য ও পরিমিতির সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকর গোত্রের প্রাণীকুলের জন্য জীবনযাপন ও খাদ্যান্বেষণের পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.)-এর জবানে বলেছেন, ‘সে বলল, আমাদের প্রতিপালক তিনিই, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন, তারপর পথনির্দেশ করেছেন।’ (সুরা তহা : ৫০)।
হাসান বসরি (রহ.) ও কাদাতা (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক বস্তুকে উপযোগিতা দান করেছেন এবং যা কিছু তার উপযোগী, তার পথনির্দেশ করেছেন। (আল জামিউ লি আহকামিল কোরআন : ১১/২০৪)। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সবকিছু সুঠাম করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করে পথনির্দেশ করেন।’ (সুরা আলা : ২-৩)।
আল আলুসি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা যাবতীয় জিনিসকে নির্দিষ্ট পরিমাপে সৃষ্টি করেছেন; গোত্র ও বর্গের ক্ষেত্রে, এককের ক্ষেত্রে, বৈশিষ্ট্য ও কর্মকাণ্ড এবং জীবনকালের ক্ষেত্রে পরিমিতি বজায় রেখেছেন। প্রত্যেক জিনিসকে তার স্বভাব এবং প্রাকৃতিকভাবে বা অভিপ্রায়, সে অনুযায়ী যা কিছু তার জন্য ভালো, সেদিকে পথনির্দেশ করেছেন। যাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য তা সহজ করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সেই ধরনের ঝোঁক ও প্রেরণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। দলিল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আয়াতসমূহ নাজিল করেছেন। তুমি যদি উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণীজগতের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যানুসন্ধান কর, তাদের মধ্যে এমনসব ব্যাপার দেখতে পাবে, যা অতিশয় বিস্ময়কর এবং সেগুলো কাগজে লিখে শেষ করা যাবে না। অন্যদিকে আল্লাহতায়ালা মানুষকে বিশেষভাবে যে পথনির্দেশ করেছেন, তার বিষয়-বৈচিত্র্য সৃষ্টিজগতের অন্য সবকিছুর চেয়ে কয়েক স্তরে উন্নত; অন্য সবকিছুর চেয়ে হাজার হাজার মঞ্জিল দূরের। বর্ণনা করে ও লিখে তা শেষ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সূক্ষ্মদর্শী মহাজ্ঞানী আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।’ (তাফসিরে রুহুল মাআনি : ৩০/১০৪)। আরবি থেকে অনুবাদ। আবদুস সাত্তার আইনী।