মানব কল্যাণে প্রকৃতি
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবী মানুষের সেবায় অনুগত। মানুষকে আল্লাহতায়ালা মর্যাদাবান করে বানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি আদম সন্তানদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে আমি উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের ওপর আমি তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৭০)। এসব নেয়ামত ও সম্মান দানের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা কি দেখ না, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন। মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে। তাদের না আছে পথনির্দেশ, আর না আছে কোনো দীপ্তিমান কিতাব।’ (সুরা লোকমান : ২০)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, ‘তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবকিছুকে এবং তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহ। আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন, যাতে তা পতিত না হয়, পৃথিবীর ওপর তার অনুমতি ছাড়া। আল্লাহ নিশ্চয় মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’ (সুরা হজ : ৬৫)।
প্রাণীজগৎ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন; তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে। তা থেকে তোমরা আহার করে থাক। তোমরা যখন গোধূলিলগ্নে সেগুলোকে চারণভূমি থেকে ঘরে নিয়ে আস এবং সকালে সেগুলোকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা তার সৌন্দর্য উপভোগ কর। তারা তোমাদের ভার বহন করে নিয়ে যায় এমন দেশে, যেখানে প্রাণান্ত ক্লেশ ছাড়া তোমরা পৌঁছাতে পারতে না। তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু। তোমাদের আরোহণ ও শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন অশ্ব, অশ্বতর ও গাধা এবং তিনি সৃষ্টি করেন এমন অনেক কিছু, যা তোমরা অবগত নও।’ (সুরা নাহল : ৫-৮)।
উদ্ভিদজগৎও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা থেকে জন্মায় উদ্ভিদ, যাতে তোমরা পশু চারণ করে থাক। তিনি তার দ্বারা তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেন শস্য, যায়তুন, খেজুরগাছ, আঙ্গুর ও সব ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা নাহল : ১০-১১)।
সমুদ্রজগৎও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সমুদ্রকে অধীন করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা মাছ আহার করতে পার এবং যাতে তোমরা তা থেকে আহরণ করতে পার রত্নাবলি, যা তোমরা ভূষণরূপে পরিধান কর। তোমরা দেখতে পাও তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে। তা এজন্য যে, তোমরা যেন তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা নাহল : ১৪)।
সৃষ্টিকুলের এসব জগৎকে আল্লাহতায়ালা মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করে দিয়েছেন। সৃষ্টিজগতের প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের অন্তরে এবং তার চিন্তা ও অনুভবে গুরুত্ব নিয়ে বিরাজমান। সৃষ্টিজগৎ কোনো ঈশ্বর বা ইলাহ নয় যে, তার কাছে আশার বেসাতি বসানো যায় বা তার ভয়ে ভীত থাকতে হয়। অবশ্য এরূপ ধারণা রয়েছে কিছু ধর্মাদর্শে, যেখানে বিশ্বজগৎকে বা বিশ্বজগতের কোনো কোনো অংশে ঈশ্বর ও ইলাহরূপে বিশ্বাস করা হয়। সৃষ্টিজগৎ মানুষের শত্রুও নয় যে, মানুষ তাকে বশীভূত করতে চাইবে। পাশ্চাত্যের লোকেরা এ ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকে। একে ‘প্রকৃতিকে জয় করা’ বলে আখ্যায়িত করে। বিশ্বজগৎ বরং আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি, যা মানুষের কল্যাণে ও মানুষের সেবায় নিয়োজিত। (রিআয়াত্রল বাইয়্যিয়াহ ফি শরিআতিল ইসলাম : ৩৪)।
আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগৎ থেকে এরূপ ‘বশ্যতা’ সরিয়ে নিলে ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। সৃষ্টিজগতের প্রত্যেক বস্তুর তখন স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অভিপ্রায় থাকবে। সে চাইলে মানুষের অভিপ্রায়ের বিপরীতে অন্য কিছু করতে পারবে। অথবা অন্তত এতটুকু ঘটবে যে, মানুষে সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুকে কাজে লাগাতে চাইলে ওই বস্তুর সঙ্গে তার একমত হতে হবে বা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তখন কী ঘটবে? কী ঘটবে যদি জমিন মানুষের জন্য ‘শয্যা’ হতে অস্বীকার করে অথবা গোটা জমিন হয়ে পড়ে পাথুরে ভূমি কিংবা পরিণত হয় পর্বতমালায় বা বিক্ষিপ্ত দ্বীপপুঞ্জে? অথবা যদি আকাশের অভিপ্রায় জাগে, সে যখন চাইবে বৃষ্টিবর্ষণ করবে, যখন চাইবে উল্কাপাত করবে এবং যখন চাইবে বজ্রপাত ঘটাবে? কী অবস্থা হবে যদি ঘোড়া, খচ্চর, গাধা বা জাহাজ, রেল ও উড়োজাহাজ সম্পূর্ণরূপে অবাধ্য হয়? তখন তো সেগুলো মানুষকে সেগুলোর ব্যবহারের কোনো সুযোগই দেবে না!
এগুলো আল্লাহতায়ালার নেয়ামত। অথচ এমন লোক কমই মিলবে, যারা এগুলো অনুভব করে, এগুলোর মূল্যায়ন করে এবং এসব নেয়ামতের জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি রাতকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ ছাড়া এমন কোনো ইলাহ আছে, যে তোমাদের আলো এনে দিতে পারে? তবু কি তোমরা কর্ণপাত করবে না? বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি দিবসকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ ছাড়া এমন কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদের জন্য রাতের আবির্ভাব ঘটাবে; যাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার? তবু কি তোমরা ভেবে দেখবে না?’
ইসলামি সংজ্ঞা অনুযায়ী এ বিশ্বজগৎ মানুষের বসবাসস্থল এবং তার জীবিকা অন্বেষণের জায়গা। আর তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’ (সুরা বাকারা : ৩৬)।
শায়খ রশিদ রেজা বলেছেন, ‘এ আয়াত থেকে দুটি বিষয় বোঝা যায়- ১. মানুষের বসবাসের জন্য ও উপভোগের জন্য পৃথিবী প্রস্তুত; ২. পৃথিবীতে জীবনের প্রকৃতি স্থায়িত্ব ও চিরকালীনতার বিপরীত, অর্থাৎ নশ্বর।’ (তাফসিরুল মানার : ২৩১)। এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের জন্য তিনটি বিষয়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তা হলো, ১. বসবাসের জায়গা। (তাফসিরে তাবারি : ১/৫৩৯)। ২. যা কিছু উপভোগ করা হয়; জীবিকার যা কিছু ভোগ করা হয় অথবা সাজসজ্জা কিংবা আস্বাদন ও উপভোগ বা অন্যকিছু। (তাফসিরে তাবারি : ১/৫৪০)। ৩. ইলাহহীন অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত অথবা পার্থিব জীবন শেষ হওয়া পর্যন্ত। পৃথিবীর এই যে তিনটি বৈশিষ্ট্য, এগুলোর সঙ্গে মানুষ প্রেম ও স্বস্তির অনুভূতি নিয়ে জড়িত। কেননা, পৃথিবী তাদের আশ্রয়স্থল; মানুষ কল্যাণ ও আস্বাদন লাভের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর দ্বারা উপকৃত হয়। কেন না, পৃথিবী তাদের উপভোগের স্থান। মানুষ যখন পৃথিবীর সঙ্গে জীবনযাত্রায় অংশীদার হয়, সে উপলব্ধি করতে পারে, এটা ক্ষণিকের স্থান। জীবনের এ সময়টুকু দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে। যা তাকে পার্থিব জীবনে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সে আল্লাহতায়ালার সামনে তার পার্থিব জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
মোটকথা, ইসলাম মানুষ ও সৃষ্টিজগতের মধ্যে এক শক্তিশালী বন্ধুত্বের সম্পর্ক নির্মাণ করে দেয়। এ বন্ধুত্ব হলো ভ্রাতৃত্বসুলভ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত। বিশ্বজগৎ, জীবন ও মানুষের মধ্যে যে সৃষ্টিগত ঐক্য রয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে। যৌথভাবে আল্লাহর ইবাদত ও আল্লাহর মহিমা ঘোষণাতেও সৃষ্টিজগৎ ও মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব রয়েছে। সৃষ্টিজগৎ যে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত, এ অনুভূতিও এই বন্ধুত্বের নিয়ামক। ইসলাম জীবজগতের মধ্যে ভালোবাসার যে ঐকতান সৃষ্টি করেছে, তাতে মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য বাসিন্দাও শরিক। (মানহাজুত তারবিয়্যাতিল ইসলামিয়্যাহ : ১৪৫)।