নবান্নে বাঙালিমানস আত্মহারা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঋতুবৈচিত্র্যের এ পালল ভূমিতে ১২ মাসে ১৩ পার্বন অনুষ্ঠিত হয়। লাঙলের ফলার মাঝে লুকিয়ে রাখা নিজস্ব আভিজাত্যকে একেক ঋতু খুলে বসে প্রকৃতির সর্বাঙ্গে। শুধু প্রকৃতিতে নয়, জনজীবনেও এ আভিজাত্যের প্রভাব বিদ্যমান। আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সমৃদ্ধতার শুরু যেমন কৃষি থেকে, তেমনি মাটির সোঁদাগন্ধ মিশে থাকে আমাদের প্রতিটি উৎসবে। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর এ ধরায় ষড়ঋতুর দেশে দু’মাস অন্তর অন্তর ঋতু বদল ঘটে। গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে, শরতের পরেই আসে হেমন্ত। হেমন্তকে বলা হয় অনুভবের ঋতু; যা ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্ট। তাকে যেভাবে অনুভব করা যায়, ঠিক সেভাবে ছোঁয়া বা দেখা যায় না। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত তীব্র, প্রখর অথবা উন্মোচিত নয়। বসন্তের মতো নেই তার বর্ণ, গন্ধ, গরিমা। হেমন্ত মৌন, শীতল; বলা যায় অনেকটা অন্তর্মুখী। আমাদের দেশে হেমন্ত আসে ধীর পায়ে, শিশিরস্নাত শীতল পরশ আলতো গায়ে মেখে মেখে। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই কৃষিপ্রধান এ দেশে সূচনা হয় নবান্ন উৎসব। ইংরেজিতে যাকে বলে, নিউ রাইস ফেস্টিবল।

নবান্নের শাব্দিক বিশ্লেষণ : ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এ উৎসব পালন করা হয়। এ উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি আবহমান বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের কষাঘাতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আনন্দময় সরল জীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব। তবে নাগরিক জীবনে নবান্নের শুভক্ষণের শুভ ছায়া ছড়িয়ে দিতে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসব। সত্যি কথা বলতে কি, শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা তো প্রতীকী।

খাদ্যসংগ্রহের প্রাচীন উৎসব : সমাজ ও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষের খাদ্যসংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যকে কেন্দ্র করে উদ্ভব ঘটেছে নানা উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের। অরণ্যচারী আদিম মানুষ যখন খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি, বেঁচে থেকেছে শুধু প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত খাদ্যের জোরে। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় ‘খাদ্য আহরণ অর্থনীতি’র সেই আদিস্তরেও খাদ্য সংগ্রহের সাফল্যে উৎসবের আয়োজন হয়েছে তাদের দলে বা গোষ্ঠিতে। এমনি এক উৎসবের প্রথম আয়োজন হয়েছিল হয়তো বড় দুর্জয় কোনো বন্যপশু শিকারের আনন্দকে বড় রূপ দেওয়ার জন্য। দক্ষিণ ফ্রান্সের ‘টোরেস ফেরেস’ গুহাগাত্রে পাথর খোদাই করে অঙ্কিত হরিণের চামড়া ও শিং পরে নৃত্যরত মানুষের চিত্রসহ আরো অনেক গুহাচিত্র থেকে সমাজ বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন। আফ্রিকার ব্যুশম্যান উপজাতির মধ্যে আজও প্রচলিত ‘কৃষ্ণষাঁড় নৃত্য’; যা খাদ্য সংগ্রহের সাফল্যকেন্দ্রিক একটি প্রাচীন উৎসব। এ ধরনের উৎসব আদিম মানুষকে খাদ্য আহরণে সংঘবদ্ধ ও সাহসী করেছে। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানবসভ্যতার যখন ‘খাদ্য আহরণ’ যুগ থেকে ‘খাদ্য উৎপাদন’ অর্থাৎ কৃষি অর্থনীতির যুগে উত্তরণ ঘটে, তখন ফসল উৎপাদনের পেছনে কোনো না কোনো অদৃশ্য দৈব শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে নানা বিশ্বাস ও সংস্কার। যার ভিত্তিতে ফসল উৎপাদনকেন্দ্রিক উৎসবের ধরন বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের দৈবশক্তির সাহায্য প্রার্থনা করে নানা আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা যুক্ত হয়েছে এসব উৎসবে।

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন : নবান্ন এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। নবান্ন উৎসব বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে নবান্ন উৎসবের সঙ্গে। কৃষিনির্ভর এ সমাজে কৃষিজমির সঙ্গে আমাদের নীবিড় সম্পর্ক সূত্রেই নবান্ন হয়ে উঠেছে বাংলার লোকায়িত উৎসব। মাঠ ভরা ধানে সোনালি ছোঁয়া লাগলেই গ্রাম-বাংলায় বোঝা যেত যে, নবান্ন আসছে। কার্তিকের শেষ সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে যেত ধান মাড়াইয়ের কাজ।

চলত বাড়িঘর, ঢেঁকিঘর নিকানোর কাজ। নতুন ধান থেকে চাল ছাঁটা হতো ঢেঁকিতে। তৈরি করা হতো চালের গুঁড়া। চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা তৈরি হতো নবান্নে। এ ছাড়া চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা হতো মাঙ্গলিক আলপনা। বাড়ির নারী সদস্যরা ব্যস্ত থাকতেন চিঁড়া, মোয়া, নাড়ু তৈরিতে। এক সময় নবান্ন উৎসব উপলক্ষ্যে চলত খন ও বিষহরি পালাগানের আসর। বসত মেলাও। নবান্নে পাকা ধান দেখে চাষি আনন্দে গেয়ে উঠত। আমাদের দেশে আবহমান কাল ধরে প্রচলিত এ ‘নবান্ন’ উৎসব সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত। তাই নবান্ন উপলক্ষে ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দের সারা পড়ে যায়। কৃষকের আঙিনা-উঠান লেপে-পুছে ঝকঝকে তকতকে করে তোলা হয়। নতুন কাস্তে, ডালি, কুলা, চালুনি, ঝাটা, চাটাই তৈরি হয়। কৃষক মাথায় অথবা কোমরে নতুন গামছা বেঁধে সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে উঠানে।

ধান ভানার গান ভেসে বেড়াত বাতাসে : কৃষাণ বধূর ব্যস্ততা বেড়ে যায় ধান মাড়াই-ঝাড়াই, সেদ্ধ-শুকানো, চাল-আটা তৈরি আর রকমারি রান্নাবান্না নিয়ে। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামগুলো। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠাণ্ডপুলি, ক্ষীর-পায়েস ইত্যাদি। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। নবান্ন উপলক্ষ্যে অনেক গ্রামে লোকমেলার আয়োজন হয় কোনো বটের তলায় কিংবা খোলা মাঠ-প্রান্তরে। নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো এ লোকমেলা। এ মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটি-বাঁশ-বেত, কাঠের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আর বসে পালাগান, লোকনাট্য, কেচ্ছা-কাহিনি, বাউল গানের আসর। নাচ আর গানে মুখরিত হয় মেলাপ্রাঙ্গণ। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্মহারা হয়ে ওঠে বাঙালিমানস।

বাংলা সাহিত্যে নবান্ন : বাংলার কবি-সাহিত্যিকরা নতুন ফসল ঘরে ওঠার ঋতু হেমন্ত আর নবান্ন উৎসবকে নিয়ে লিখেছেন কবিতাণ্ডগান। ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্র্যে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাস তথা হেমন্ত ঋতু আসে নতুন ফসলের সওগাত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালি দিন। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালি ধানের সম্ভার স্বগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলাদেশ। তাই বিপুল বিস্ময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়ে ওঠেন, ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’ হাসি ফোটে কৃষকের মুখেও; মাঠ ভরা সোনালি ফসল নতুন স্বপ্ন জাগায় চোখে। কবি সুকান্ত’র ভাষায় যেন, ‘নতুন ফসলের সুবর্ণ যুগ আসে। এ হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান।’ নবান্নের বর্ণনা তিনি তার ‘এই নবান্নে’ কবিতায় এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন। হেমন্ত ঋতুর দিনরাতের অবিশ্রান্ত শ্রমে কৃষকের ঘরে ওঠে সোনার ধান। বাংলার গ্রামগঞ্জ মেতে ওঠে নবান্নের উৎসবে। ‘ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরনীর সওগাত? নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় এভাবে নতুন আমন ধানের অঘ্রাণে অগ্রহায়ণকে মাৎ করে দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়েছে। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন হেমন্তে মাঠ ভরা ফসলের সম্ভারে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান, সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।’ কবি আল মাহমুদ লেখেন, ‘আজ এ হেমন্তের জলজ বাতাসে, আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে। রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে, আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো কট ও কষায়।’ হেমন্ত তো এমনই। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাই হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান হয়ে প্রকৃতির হাতচিঠি পৌঁছে দেন মানুষের রুদ্ধ দুয়ারে। সে দুয়ারের দ্বার শীতের আগে খুললেও স্পর্শসুখ মরমে পৌঁছায় তো?

হেমন্ত আসুক অপার সম্ভাবনায় : দিনবদলের পালায় গ্রামের মানুষের কাছে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে নবান্নের আনন্দ। আগে নতুন ধান গোলায় ওঠার সময় যেভাবে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত, তা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পিঠাণ্ডপুলি, পায়েশের সেই আয়োজন আর তেমন চোখে পড়ে না। সময় পরিবর্তনের হাওয়ায় সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে।

ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন। এখন নাগরিক সংস্কৃতির আগ্রাসনে গ্রামীণ সংস্কৃতি যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। নবান্ন উৎসবের মতো গ্রামবাংলার অনন্য ঐতিহ্যও হারিয়ে যাচ্ছে। আসলে এখন পারিবারিক বন্ধনটা আর আগের মতো নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি আত্মিক টান কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সংস্কৃতিতে। পিঠাণ্ডপুলি খাওয়ার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি পাল্টে যাওয়ার কারণে এখন আর নবান্ন উৎসব আগের মতো দেখা যায় না।

নবান্নের উৎসব এখন মেকি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে, কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি। বাঙালির নবান্ন তথা উৎসবের ঋতু হেমন্ত, নবান্নের আশা জাগানিয়া, দুঃখ ভোলানিয়া হেমন্ত। স্বপ্নের জাগরণে হতাশা আর নিরাশা ভুলে চলত নবান্নের উৎসব। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনের আশা হোক, ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্ত আসুক অপার সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির শুভ সংবাদ নিয়ে।