সবুজ ফসলের মাঠজুড়ে কাঁচা-পাকা ধানের আভা। শুরু হলো অগ্রহায়ণ। হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা হেমন্তকাল সবুজ-হলুদ রঙে আমনের মণ্ডম সুবাস ছড়িয়ে দিগন্তজোড়া আনন্দ আহ্বানে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ফসলের বার্তা। পহেলা অগ্রহায়ণ বাংলার কৃষক পরিবারের নবান্নের প্রথম দিন হিসেবে দেশজুড়ে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস। তবে অগ্রহায়ণ মাসে মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে। ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষানির। মানবসমাজে জীবিকার প্রয়োজনে কৃষিপ্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই বিভিন্ন কৃষ্টি মেনে ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম।
শীতের পূর্বাভাস ঋতু : ষড়ঋতুর বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ ২ মাস হেমন্তকাল। অগ্রহায়ণের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল থাকবে হেমন্তের আধিপত্য। হেমন্তের প্রকৃতি হিম হিম ভাব নিয়ে কুয়াশার শীতল আভা ছড়িয়ে দেয়। হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু। শরৎকালের পর এ ঋতুর আগমন। শীতের আগাম আভাস দেয় বলে তাকে শীতের পূর্বাভাস ঋতুও বলা হয়। প্রকৃতির মায়ায় নানা রং-রূপের বৈচিত্র্য নিয়ে আগমন করে বলে গ্রাম-বাংলায় এ ঋতু উৎসবের ঋতু বলেও পরিচিত। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী পূর্বাভাস পাওয়া যায় হেমন্তের শুরু থেকেই। কৃষকের কষ্টের সম্পদ ফসল তখন মাঠজুড়ে কাঁচাপাকা ধানের বর্ণিল অপরূপ সাজে কৃষকের মনে আনন্দের দোলা দেয়। এ শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। বাড়ির আঙিনা-উঠান পরিষ্কার করে সোনার ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নেয় কৃষক-কৃষানিরা।
কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয় : হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ মনের আনন্দে ধান শুকোয়। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। বাড়ির চারপাশে লাউ, শিম, মুলা, বেগুনসহ সবজি গাছগুলো সতেজতায় প্রাণ জাগায় প্রকৃতির সবুজ অঙ্গনে। ভোরের হালকা কুয়াশার পরশ, সকালের সোনা রোদ, দুপুরের ঝকঝকে উচ্ছল রোদ্দুর, বিকেলের হিমেল আভা; প্রকৃতির সবকিছুতে যেন আনন্দের নতুন বার্তা ভেসে বেড়ায়। একসময় বাংলায় বছর শুরু হতো ধান উৎপাদনের ঋতু হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। এভাবেই হেমন্ত আসে কৃষকের দুয়ারে ফসলের হাসি নিয়ে। এ ঋতুতে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল ফুটে প্রকৃতিকে অনিন্দ্য রূপময়ী করে তোলে।
ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়াত : অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবমতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। এ সময় অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষানির। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে ঢেঁকির তালে। মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। যদিও বা যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামবাংলা। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চীন সম্রাট চীন সিং স্বয়ং মাঠে ধান বপন করে দেশব্যাপী একটি বার্ষিক উৎসবের প্রবর্তন করেন। জাপানে অতি প্রাচীনকাল থেকে সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এ উপলক্ষ্যে জাতীয় ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। বঙ্গীয় এলাকায় আদিকাল থেকেই অনার্য বাঙালিরা নবান্ন উৎসব উদযাপন করত। নানা আনুকূল্যে সে রেওয়াজ আজও আর নেই।
নবান্ন হেমন্তের প্রাণ : কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার প্রধান কৃষিজ ফসল কাটার মৌসুম এ অগ্রহায়ণ মাস। বাঙালির জাতীয় জীবনে স্মরণাতীতকাল থেকে পহেলা অগ্রহায়ণকে বিবেচনা করা হয় বছরের শুভদিন হিসেবে। এ দিনটিকে নবান্নের দিন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এ নবান্নকেই আবার হেমন্তের প্রাণ বলা হয়। নবান্নের সঙ্গে বাংলার কৃষি ও কৃষক পরিবারের আনন্দ, আতিথেয়তার গভীর সম্পর্ক। কেননা, নতুন ধান কাটার সঙ্গে কৃষকদের পারিবারিক জীবনের পরিবর্তনের সম্পর্ক জড়িত। এ ফসল ঘরে তুলে পরিবারের সদস্যদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ চালানো হতো। তাই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিয়ানার পরিচয় বিস্তৃত হয়েছে এ নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে। প্রচলিত সনাতনী রীতি অনুযায়ী নতুন ধান কাটা আর সেই সঙ্গে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। কনের জামাতাকে নিমন্ত্রণ করা হয় নতুন ফসলের পিঠাপুলি, পায়েস খাওয়ার জন্য। বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয় মেয়েকে। ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠাপুলি আর পায়েসের আয়োজন করা হয়।
হেমন্তে জাতীয় কৃষি দিবস : অগ্রহায়ণের প্রথম দিন অগ্র অর্থ ‘প্রথম’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। একসময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ। যদিও আকাশ সংস্কৃতির হাল আমলে অনেকটাই পাল্টে গেছে সেই অগ্রহায়ণের চিরাচরিত উৎসবের রীতি।
এ পালন যেন ভুলতে বসেছে আধুনিক মনস্ক কৃষক সমাজও। তবু কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার সরল জীবন যাপনের প্রতীক এ নবান্ন উৎসব একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বাঙালির জীবন থেকে। এখন সরকারি উদ্যোগে অগ্রহায়ণের এ আনন্দের দিনটি মহিমান্বিত করে রাখার উদ্যোগ হিসেবে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনকে জাতীয় কৃষি দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগের আয়োজনে সারা দেশেই পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস।
সামগ্রিক অগ্রগতির নাম কৃষি : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনও গ্রামে বাস করে। গ্রামের প্রায় ৬০ ভাগ লোকের জীবন-জীবিকা এখনও কৃষি ও খামারভিত্তিক। শহরেও শতকরা প্রায় ১১ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান শতকরা ১৫.৩৩ ভাগ। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান ৪৮.১ ভাগ কর্মজীবী মানুষের। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে ফসলি জমি কমার পরও কৃষি ক্ষেত্রে দেশের অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে। এটি খুবই আশার দিক।
১৯৭১ সালে যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন অসম্ভব হতো, সেখানে জমি কমার পরও ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের ধারাবাহিকতার ফলে কৃষি এখন শুধু ফসলের মাঠে নয়, মাছ, গবাদি পশুপালন, সবজি ও ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ থেকে শুরু করে ব্যতিক্রম এবং নতুন নতুন কৃষিজ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও সাফল্য দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে আশার আলো দেখাচ্ছে। ধান, পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, শাকসবজি, রকমারি ফল, সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদি পশু, পোলট্রি মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকায় শীর্ষত্বের লড়াই করছে বাংলাদেশের কৃষি। কাজেই কৃষি এখন সামগ্রিক অগ্রগতির নাম।