আমন ধান : অগ্রহায়ণে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে, তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান ৮০ শতাংশ পাকলে কেটে ফেলতে হবে। আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে রাখতে হবে। এতে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটির রস কম শুকাবে। উপকূলীয় এলাকায় রোপা আমন কাটার আগে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি আবাদ করতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ থেকে সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই থেকে ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করতে হবে। পরিষ্কার ঠান্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের ওপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সঙ্গে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়ি করে মিশিয়ে দিতে হবে।
বোরো ধান : অগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে, এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২ থেকে ৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় ঠান্ডার প্রকোপ বেশি, সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫ থেকে ৩০ সেমি নালা রাখতে হবে। বোরো মৌসুমের পানি সাশ্রয়ী ব্রি ধান ৯২। এছাড়া যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে, সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান ৪৫ এবং ব্রি ধান ৫৫, ব্রি ধান ৬৭, ব্রি ধান ৮১, ব্রি ধান ৮৪ ও ব্রি ধান ৮৬, ব্রি ধান ৮৮, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নেই, এমন এলাকায় ব্রি ধান ২৯, ব্রি ধান ৫০, ব্রি ধান ৫৮, ব্রি ধান ৫৯, ব্রি ধান ৬০, ব্রি ধান ৬৩, ব্রি ধান ৬৪, ব্রি ধান ৬৮, ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯২ ব্রি হাইব্রিড ধান ১, ব্রি হাইব্রিড ধান ২ ও ব্রি হাইব্রিড ধান ৩, ঠান্ডা প্রকোপ এলাকায় ব্রি ধান ৩৬, হাওর এলাকায় বিআর ১৭, বিআর ১৮, বিআর ১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান ৪৭, ব্রি ধান ৫৫, ব্রি ধান ৬১ চাষ করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০ থেকে ৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম : অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে, ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো থেকে আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- বারি গম ২৫, বারি গম ২৮, বারি গম ২৯, বারি গম ৩০, বারি গম ৩১, বারি গম ৩২, বারি গম ৩৩ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম ১ বপন করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। গজানোর ক্ষমতা ৮০ শতাংশ বা তার বেশি হলে বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি বীজ বপন করতে হবে। সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি শতক জমিতে ৩০ থেকে ৪০ কেজি জৈবসার, ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ থেকে ৪৫০ গ্রাম এমওপি, ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুরবেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত ইউরিয়া শেষ চাষের সময় অন্যান্য সারের সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ, ৫০ থেকে ৫৫ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫ থেকে ৮০ দিনে তৃতীয় সেচ দিতে হবে।
ভুট্টা : ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো- খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা ৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৬, বারি মিষ্টি ভুট্টা ১, বারি বেবি কর্ন ১। খরা প্রধান এলাকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৩। এক শতাংশ জমিতে হাইব্রিড বীজ বপনের জন্য ৮০ থেকে ৯০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি রাখতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ২ থেকে ২.২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫০ থেকে ১০০০ গ্রাম, এমওপি ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম, জিপসাম ৯৫০ থেকে ১০০০ গ্রাম, দস্তা ৪০ থেকে ৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০ থেকে ৩০ গ্রাম এবং ১৬ থেকে ২০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল : তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। এছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী আবাদ করতে পারেন। সরিষা গাছে ফুল আসার সময় শতাংশপ্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০ থেকে ২৫ দিন পর আবারও একটি সেচ দিতে হবে।
আলু : উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে। কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরি প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
শাকসবজি : মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা- এসব বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২ থেকে তিন সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও ভালো থাকবে। জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া চাষ করতে পারেন। মিষ্টিআলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসব ফসলের কোনোটি এখনও না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিসি, যব বপন করা যায়।
গাছপালা : এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যত্ন নিতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয়, তাই পারতপক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না।
প্রাণিসম্পদ : হাঁস থেকে মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। এছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোলট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। রানিক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস থেকে মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ মাসে পশুখাদ্যের কোনো অভাব থাকে না। বিশেষ করে, কাঁচা ঘাসের। তাই আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমন- ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন। এ সময় গবাদিপশুর খুরা রোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপশুতে রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণী চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্য সম্পদ : মাছের খাবার হিসেবে রাসায়নিক সার এ সময় বেশি উপযোগী। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। পুকুরে রোদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায়। কার্পজাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া মাছ-সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাক