ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নবান্নের ঘ্রাণ শুভ্র সারথি

নবান্নের ঘ্রাণ শুভ্র সারথি

অগ্রহায়ণ মাস মানেই মধ্যবিত্ত গ্রামীণ কৃষিজীবনে উৎসবের আমেজ। অভাবের কার্তিককে পেছনে ফেলে নতুন ফসলের গন্ধ নিয়ে এসেছে অগ্রহায়ণ। এরই মধ্যে নীরবে প্রকৃতিতে ঘটছে ঋতুর পালাবদল। আসছে শীতকাল। বাংলায় বর্ষা বাদে আর সব ঋতুই আসে নিঃশব্দে, চলেও যায় একই কায়দায়; ব্যতিক্রম কেবল বর্ষা। বিষণ্ণ দিনে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম, মাঝেমধ্যে ঝড়ের নিনাদ বর্ষার এক সরব অনুষঙ্গ। আর নীরবতা, নৈঃশব্দের কথা বললে শীতের কাছে হার মানবে অন্যসব ঋতু। কিন্তু এ নীরবতায় পুরো প্রকৃতিতে এত পরিবর্তন ঘটে, যাকে বলতে হবে নীরব বিপ্লব। আধুনিক বাংলা কবিতায় পথপ্রদর্শক কবি জীবনানন্দ দাশ হেমন্তকে কেন ভালো বেসেছেন, কে জানে! তার কাছে হেমন্ত ছিল ‘ঋতুর রাজা’; বসন্ত নয় কিংবা বর্ষাও নয়। জীবনানন্দের সত্তাজুড়ে ছিল কার্তিক-অগ্রহায়ণের ইন্দ্রিয়াতুর রূপ, গন্ধ ও স্পর্শময় অনুভূতি।

জীবনানন্দের আগে আর কোনো বাঙালি কবি হেমন্ত ঋতুর গুপ্ত সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে এমন সূক্ষ্মভাবে কবিতায় তুলে আনেননি। অবসরের গান কবিতায় তিনি যখন লেখেন, ‘চারদিকে ন্যুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে।’ তখন বোঝা যায়, এ দৃশ্য অগ্রহায়ণের এ অনুভূতি নতুন ফসলের নবান্ন উৎসবের আমেজ। কবির প্রিয় ওই অগ্রহায়ণ এসে গেছে প্রকৃতিতে। স্বল্প সময়ের জন্য এলেও বাতাসে অগ্রহায়ণের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে কিছুদিন ধরেই। তবে তা শহরে নয়, গ্রামে। নগরে উৎসব হলেও প্রকৃত বিষয় হলো, অগ্রহায়ণের রূপ ও উৎসব শহরকেন্দ্রিক নয়। শহরজুড়ে শীতের সামান্য আমেজ থাকলেও শস্যভরা, ঘ্রাণময় অগ্রহায়ণ এখানে নেই। এর পরও হাজার বছরের ঐতিহ্যকে মনে রেখে শহরেও নবান্ন উৎসব হচ্ছে; তা বড় আনন্দের।

অগ্রহায়ণ বাংলা সনের অষ্টম এবং শতাব্দের নবম মাস। প্রাচীন বাংলা ভাষায় এ মাসটিকে আঘন নামে চিহ্নিত করা হতো। ‘অগ্রহায়ণ’ শব্দের অর্থ- বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি (ধান) উৎপন্ন হয়। অতীতে অগ্রহায়ণে প্রচুর ধান উৎপাদিত হতো বলেই একে ধরা হতো বছরের প্রথম মাস। পশ্চিমবঙ্গের লোকসমাজে অগ্রহায়ণ মাসকে ‘লক্ষ্মীর মাস’ মনে করা হয়। এছাড়া অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসবে বিশেষ আয়োজন তো ঐতিহ্যেরই অনুষঙ্গ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এক সময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। ফসল তোলার উৎসব ও নববর্ষের উৎসব- এ দুই উৎসব ধারণ করে অগ্রহায়ণ বিশাল বাংলার জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত ছিল দীর্ঘকাল। সকালে হালকা কুয়াশার চাদর সরিয়ে শিউলি কুড়ানো, দলবেঁধে খেজুরের ঠান্ডা কাঁচা রসে গলা ভেজানো, সন্ধ্যায় খড়কুটো জ্বালিয়ে পাড়ায় পাড়ায় গানের আসর, শুকিয়ে আসা খাল-বিলে দলবেঁধে মাছ যে না ধরেছে, সে কীভাবে বুঝবে তার আনন্দ? পাতা ঝরে গাছগুলো ন্যাড়া হলেও রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি বেড়ে যায়। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সোনালি, বেগুনি, কালোসহ বহুবর্ণের ঐন্দ্রজালিক ছটা যেন শিল্পীর সৃষ্টিকেও হার মানায়। প্রজাপতির এ নাচন মানুষের মনেও ধরায় রঙের নাচন। এসব কিছু এক লহমায় হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়ে যায় যেন। বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘ্রাণময় অগ্রহায়ণ ও শীতের আয়োজন ছড়িয়ে বসে রয়েছে। কিন্তু শহরে তার এমন দেখা মেলে কই! তাই তো মনে হয়, জীবনানন্দ দাশের মতো করে বিড়বিড় করে বলি, ‘বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে/ হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে পড়ে গেছি ঝরে।’

লেখক : কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত