শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শব্দদূষণ এক ধরনের পরিবেশ দূষণ; এক নীরব ঘাতক। ঢাকা শহরে যানজট সমস্যার পাশাপাশি শব্দদূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা। রাজধানী ঢাকায় শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে তিনগুণ বেশি। ফলে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। আবাসিক, অনাবাসিক, অফিসপাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- এমনকি হাসপাতালের আশপাশেও শব্দদূষণের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিনিয়ত আমরা যেসব শব্দদূষণের মুখোমুখি হই, সেগুলো হচ্ছে- গাড়ির হর্ন, মাইকের শব্দ, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত মেশিনের শব্দ, কল-কারখানায় সৃষ্ট শব্দ, হেলিকপ্টার বা বিমানের শব্দ ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শব্দদূষণ। শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ- এ তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে। যেখানে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়। ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস শীর্ষক এ প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল; যা অন্য শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রাজধানীসহ অন্য শহরগুলোতে প্রতিনিয়তই মোটরচালিত যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের মাধ্যমে শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাসসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন নিরপরাধ জনগণ।

শব্দদূষণে বাড়ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শব্দদূষণের মাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবলের কথা উল্লেখ থাকলেও ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কানের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ গুণের বেশি শব্দ শোনা যায়। এতে করে জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই, যেটি শব্দদূষণে আক্রান্ত হয় না। তবে শব্দদূষণে তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয় মানুষের কান। কানের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। উচ্চ শব্দে মানুষ যদি বেশি সময় ধরে থাকে, সে সাময়িকভাবে বধির হয়ে যেতে পারে। হাইড্রোলিক হর্নের কারণে শব্দদূষণের মানমাত্রা ১২০ থেকে ১৩০ পর্যন্ত উঠে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো মানুষকে যদি ১০০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে ১৫ মিনিটের বেশি সময় থাকলে তার শ্রবণক্ষমতা একেবারে হারিয়ে যেতে পারে। একজন মানুষকে যদি আট ঘণ্টা করে ক্রমাগত ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল শব্দের মাঝখানে রেখে দেওয়া যায়, এক বছরের মাথায় লোকটি বধির হয়ে যাবেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর মানুষ বর্তমানে অতিমাত্রায় শব্দদূষণে আক্রান্ত। ঢাকার এমন কোনো নাগরিক হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যে শব্দদূষণের শিকার হয়নি। শিশু, নারী-বৃদ্ধরা এদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন। জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ আজ শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে নানা রকম জটিলতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে বলে ধারণা। ফলে বাড়ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বিধান : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারা মতে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড উভয়ের বিধান রয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ এবং ১৪০ নং ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। এ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী নীরব এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫০ ডেসিবল নির্ধারিত হয়েছে।

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ইসলাম : শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ইসলাম কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মুসলমান হওয়ার মাপকাঠিই নির্ধারণ করেছে জিহ্বা দ্বারা তথা কটূ কথা বা উচ্চ আওয়াজ করে মানুষকে কষ্ট দেয়া না দেয়ার ওপর। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি : ১০)। নিম্নস্বরে কথা বলার মাধ্যমে শব্দদূষণ রোধ করা সম্ভব। যেমন- যখন কথা বলবে, তখন উঁচু গলায় কথা না বলে নিম্নস্বরে কথা বলবে, তখন তার দ্বারা পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পরিবেশ দূষণরোধে আল্লাহ নামাজের মতো ইবাদতেও স্বর উঁচু না করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা সালাতে স্বর উচ্চ কর না এবং অতিশয় ক্ষীণও কর না; এ দু’য়ের মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১১০)। আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা চুপি চুপি করার জন্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৫৫)। এ আয়াতে চুপিচুপি ও সংগোপনে দোয়া করা উত্তম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের শেষে এ বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছে যে, দোয়া করার ব্যাপারে সীমাতিক্রম করা যাবে না। কেননা, আল্লাহতায়ালা সীমা তিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না। আল্লাহতায়ালা জাকারিয়া (আ.)-এর দোয়া উল্লেখ করে বলেন, ‘যখন সে তার পালনকর্তাকে অনুচ্চস্বরে ডাকল।’ (সুরা মারইয়াম : ৩)। কোরআনে কারিমে আরো বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নিচু কর। নিশ্চয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট আওয়াজ হলো গাধার আওয়াজ।’ (সুরা লোকমান : ১৯)। একইভাবে মানুষের জন্য এমনভাবে গৃহনির্মাণ করা জায়েজ নয়, যা অন্যের বসবাসের জন্য হুমকি হতে পারে; তেমনি টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদির অতিমাত্রায় আওয়াজ করাও বৈধ নয়। কারণ, তা প্রতিবেশীর শান্তি বিনষ্ট করে। উচ্চস্বরে ডাকাডাকি, চিৎকার, দোয়া ও জিকিরের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা সম্পর্কিত উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলাম শব্দদূষণের ব্যাপারে কতটা সতর্ক।

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি : শব্দদূষণ প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। শব্দদূষণ রোধ করার জন্য সরকার হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এরপরও শব্দদূষণ কমছে না; বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। অথচ এ আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ফলে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শব্দদূষণ রোধ করা অতীব জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি। এ জন্য সরকারের যথাযর্থ কর্তৃপক্ষ বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে শব্দদূষণের অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু গাড়ির হর্ন কমানো গেলেই শব্দদূষণের পরিমাণ ৮০ ভাগ কমে যাবে। এই মারাত্মক ঘাতক থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। শব্দদূষণের প্রকোপ কমাতে হলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে আমাদের প্রত্যেককে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে। এছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষিত সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে।