সূর্য অনেক দেরিতে উঠে। প্রকৃতির ওপর নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। সে আলোতে যেন কোনো তেজ নেই। ফসল তোলা মাঠে যেন দিগন্তব্যাপী সীমাহীন শূন্যতা বিরাজ করে। ভালো-মন্দের সমন্বয়ের মৌসুম শীতের গল্প এটি। এর সকালে কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশাতে সবকিছু জড়সড় হয়ে আসে। সামনের কোনো কিছুই ঠিকমতো ঠাওর করা যায় না। যেন সব অস্পষ্ট লাগে। কখনো কখনো কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে, দেখলে মনে হয় সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়ানো। কোনো কোনো এলাকায় ঘন কুয়াশার সঙ্গে ঝিরিঝিরি শিশির বিন্দুর অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ে। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য মামার উঁকি দেওয়া প্রকৃতি রঙিন আভায় আবহমান বাংলার জনপদ রাঙিয়ে তোলে। রাতে রাস্তায় গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলে। এর মধ্যেই যেন শীতের রং-বেরঙের বিভিন্ন পোশাক গায়ে জড়িয়ে মানুষ গন্তব্যে ছুটে চলে।
শীতের দাপটে প্রকৃতির নীরবতা : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ষড়ঋতুতে শীতের আগমন বৈচিত্র্যময়। ঋতুচক্র ছয়টি ঋতুতে ভাগ হয়েছে। প্রকৃতি আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে বছরের বারোটি মাস দুই মাস করে ছয়টি ঋতুতে ভাগ হয়েছে। এ ছয় ঋতু হলো- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। তবে সব ঋতুর প্রাধান্য ও প্রভাব এক নয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত প্রত্যক্ষ আর শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পরোক্ষভাবে প্রকৃতিতে প্রতিফলিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত- এ তিনটি ঋতু প্রকৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জনজীবনে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত জনজীবনে অনুভূত হয়, যেন তার আগমন নীরব-নিভৃতে। ঋতুচক্রে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল ও ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। গ্রীষ্মণ্ডবর্ষার পর আসে শরৎ। কিছুটা পরে তা মিশে যায় হেমন্তে। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে এবং বসন্তের আগে। শীতকাল পৌষ ও মাঘ- এ দুই মাস হলেও এর শুরু কিছুটা আগে এবং শেষ হয় কিছুটা পরে। পৌষ ও মাঘ- এ দুই মাস নিয়ে শীতকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে শীতকালের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হিমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তাণ্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
শীতে শহর-গ্রামে নানান উৎসব : শীতের সকাল কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে। সবকিছু জড়সড় হয়ে আসে। সামনের কোনো কিছু ঠিকমতো দেখা যায় না। সবকিছুই অস্পষ্ট মনে হয়। গভীর রাত থেকে গাছের পাতায় শিশির বিন্দু জমতে থাকে। আর ভোররাতে শিশিরকণা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে। টিনের চালে, ঘরের চালে, পাতার ওপর টুপটাপ বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। সকালে মাঠে মাঠে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করে। ধানক্ষেত-শাকসবজির ওপর টলমল করা শিশির বিন্দু সূর্যের সোনালি রশ্মিতে মুক্তার মতো ঝলমল করে। এ সময় গ্রামের ক্ষেতে ক্ষেতে ধান কাটা শুরু হয়। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। শীতে এ সময় শহর-গ্রামের সবখানে চলে নবান্ন উৎসব। শীতের সকালে খেজুরের মিষ্টি রস সবার মন কাড়ে। গাছিরা কলস ভরে রস নিয়ে আসে। খেজুরের কাঁচা রস রোদে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ। খেজুর রসের পায়েস আর নলেন গুড়ের কথা ভাবলে জিহ্বায় জল এসে যায়। শীতকালে সর্বত্র নানা রকম পিঠা তৈরি হয়। গ্রামে গ্রামে রং-বেরঙের পিঠা-ক্ষীর-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে। বাড়ি বাড়ি পিঠাপুলি তৈরি হয়। রসের পিঠা, তেলে পিঠা, পাটিসাপটা এবং ভাপাসহ নানা রকম পিঠা, যা দেখলে সবার মন কাড়ে। এ সময় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শুরু হয় রকমারি পিঠা উৎসব। এছাড়া খেজুর রসের তৈরি পায়েস আর নানা রকম পিঠা নিয়ে পৌষ-সংক্রান্তির উৎসব জমে ওঠে। বাড়ি বাড়ি ছাড়াও সন্ধ্যায় হাট-বাজারে আতপ চালের গুঁড়া, নলেন গুড় এবং নারকেল দিয়ে তৈরি গরম ভাপাপিঠা ও পাটিসাপটা খেতে ভারি মজা লাগে। অন্যকে খেতে দেখলে নিজের অজান্তেই জিহ্বায় পানি এসে যায়।
ফুলে-ফলে শীতের সকাল : শীতকালে পাকা ধানের সোনালি ক্ষেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার পরপরই কৃষকরা আবার বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে গরু নিয়ে মাঠে চলে। যদিও এ দৃশ্য আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না। তবু কিছু কিছু এলাকায় গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ হচ্ছে। সারাদিনই কৃষকরা চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করেন। তারা বোরো বীজতলা, সদ্য রোপা বোরো আবাদ রক্ষা করতে সকাল-বিকাল পানি পরিবর্তন করে শীতের হাত থেকে ক্ষেত রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। শীতকালের শাকসবজিতে ক্ষেত ভরে যায়। লালশাক, পালংশাক, শিম, বরবটি, লাউ, টমেটো, গাজর, শালগম এবং মুলাসহ নানা রকম সবজি শোভাবর্ধন করে, যা আমাদের খাবার হিসেবে আকৃষ্ট করে। সরিষাফুলের হলুদ ক্ষেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য না দেখলে এ দৃশ্য বোঝানো যাবে না। আর শীতকালের রং-বেরঙের ফুল গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ ইত্যাদি শোভাবর্ধন করে। ফুলের দোকানগুলো বাহারি ফুলে ভরে যায়। এ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ করতে ফুলের দোকানগুলোতে নানা রকম ফুলের ডালি, তোড়া ও মালাসহ সুসজ্জিত ফুলের উপকরণ বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়।
সাজপোশাকে বৈচিত্র্যমুখর জনজীবন : গ্রাম্য এলাকার শীতের সকাল ও বিকাল বড়ই চমৎকার। শীতের দীর্ঘ রজনী কম্বল-লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে রাত কাটে। সকালে উঠে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় সবাই উসখুস করতে থাকে। চায়ের দোকানগুলোতে চা পানের ধুম পড়ে যায়। সকালের মিষ্টি রোদে ছেলেমেয়েরা চিড়া-মুড়ি-খেজুরের পাটালি গুড় খেতে খেতে রোদ পোহাতে থাকে। শীতের দিনের বেলা ছোট হওয়ায় বেলা মাথার উপর আসতে আসতে যেন সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় শীতের দাপট থেকে বাঁচতে সবাই জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার এবং কোটসহ রং-বেরঙের বাহারি শীতবস্ত্র পরিধান করে। সাজপোশাকে আসে বৈচিত্র্য। বাহারি এসব পোশাক দেখে চোখ জুড়ায়। শীতে প্রকৃতি যেন ঝিমিয়ে পড়ে। শীতের শুষ্কতায় প্রকৃতি বিবর্ণ-রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। হাড় কাঁপানো শীতের দাপটে অনেক অস্বস্তিকর অনুভূতির মধ্যে একটি হলো, ঠোঁট ও পা ফেটে যাওয়া। শীত থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন প্রসাধনীর কদর বেড়ে যায়।
দেশি-বিদেশি ভ্রমণবিলাসী পর্যটকের আগমন : শীতকালে অতিথি পাখির আগমন এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। পরিযায়ী পাখিরা বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের হাওর-বাঁওড় ও জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। রং-বেরঙের পাখি দেখে মন ভরে যায় আর কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত হয়। তবে এর মধ্যে কিছু দুষ্ট ব্যক্তি চুরি করে পাখি শিকার করে, যা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শীতের অনুকূল আবহাওয়ায় দেশি-বিদেশি ভ্রমণবিলাসী পর্যটকের আগমন ঘটে। বিদেশি পর্যটকের আগমনে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেড়ে যায়। এতে অর্থনৈতিক খাত সমৃদ্ধ হয়। দেশের দর্শনীয় স্থান এবং পিকনিক স্পটগুলোতে ভ্রমণকারীদের ঢল নামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষাসফর শুরু হয়। এছাড়া গ্রামের হাটবাজার এবং উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়।
শীতে আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানো : শীতের সকালে গ্রামে কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শীতকালে মাঝেমধ্যে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। আর এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে যায়। হাড় কাঁপানো শীতে মানুষ-জীবজন্তুর পাশাপাশি প্রকৃতি যেন অসাড় হয়ে পড়ে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।
এ সময় শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে যায়। যে যার সাধ্যমতো গরম কাপড় কিনে নিজেকে শীত থেকে সুরক্ষার চেষ্টা করে। শীতের সকাল ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়। শীতের সকালে শহর-গ্রামে আগুনের কুণ্ডলী তৈরি করে উত্তাপ নিতে দেখা যায় শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সি মানুষকে। এ আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার মধ্যে রয়েছে আলাদা এক অনুভূতি। ভবঘুরেরা হাটবাজার, স্কুল-কলেজের বারান্দায় আশ্রয় খোঁজে। এ সময় সরকার, দানশীল ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠন দুস্থ-গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে। শীতের কনকনে ঠান্ডায় বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীতজনিত জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ সময় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কখনো কখনো শীত বিত্তহীন ও গরিব মানুষের জীবনে দুর্যোগ হয়ে দেখা দেয়। এ সময় তারা অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করে।
অপরূপ প্রকৃতিতে ঘেরা শীতের বাংলা : গ্রাম-শহরের সব মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শীতকালের নিস্তব্ধ জনজীবন বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত হয়েছে। ঘরে বসে শীতবস্ত্র পরিধান করে টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং ফেসবুকের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আজ অনেকে সময় কাটায়। এ শীতকালে মানুষের জন্য কিছু মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, তারাই হতদরিদ্র মানুষকে, পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
দুস্থ-গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। অন্যদিকে এ দেশের বিত্তবানদের গরম কাপড়ের প্রদর্শনী বাংলার প্রকৃতিতে মন ভোলানো রূপ বিরাজ করে। সব শ্রেণির মানুষের মুখে হাসি এবং তারা শীতকালের বাহারি পোশাক পরে ফুরফুরে মেজাজে থাকে। কবি বলেন- শীত, শীত, শীত উমের চাদরে মায়ের মমতা মাখা/আমার গাঁয়ের পথ চলে গেছে বহুদূর আঁকাবাঁকা। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া/একটি ঘাসের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু। গ্রামবাংলার শীতঋতুর সত্যিই তুলনা হয় না। কোনো দেশেই নেই এ দেশের মতো এমন নয়নাভিরাম অলংকারে মোড়ানো প্রকৃতি ও মানুষ। কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে এমন দেশটি।
লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক