ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ

ড. রাগিব সারজানি
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ

আধুনিক যুগে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা হলো, প্রকৃতির সঙ্গে আচরণের সমস্যা। আমাদের এ যুগের আগে যারা পৃথিবীতে ছিলেন, তারা এ ধরনের সমস্যার কথা চিন্তাও করেননি। কারও মনে এমন ধারণার উদ্রেক করেনি যে, এ বিপুল বিশাল ভূমি ও দীর্ঘ বিস্তৃত অরণ্যরাজি দুর্বল মানুষের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে; অতল গহীন সমুদ্র মানুষের আঘাতের শিকার হবে; তাদের হাতে অসংখ্য প্রজাতির অগণিত প্রাণীর বিনাশ ঘটবে। যদিও প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, এসব প্রাণী মানুষের জীবন ও তাদের কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দূরে বসবাস করছে। অতি কল্পনাপ্রবণ মানুষের মনেও এমন খেয়াল আসেনি, মানুষের কৃতকর্মের ফলে পৃথিবীর বায়ুও একদিন নষ্ট হয়ে যাবে।

দূষণের ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি : আমাদের চারপাশের পরিবেশের সমস্যা দীর্ঘকাল ধরে মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা মানুষের জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পৃথিবীর বুকে প্রকৃতির মৌলিক উপাদানগুলো নানাবিধ দূষণে আক্রান্ত হয়েছে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটি দূষণ, খাদ্যদূষণ- এসব ধরনের দূষণ মানবজীবনে ক্ষতিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এসব দূষণের ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে; যা হাজার হাজার মানুষ ও প্রাণীর জীবন কেড়ে নিয়েছে। একইভাবে বহুরকম রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে। জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন প্রজাতির ভাইরাস। এগুলো মানবজীবন ও প্রাণীজীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আল্লাহতায়ালা যে প্রকৃতিকে পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছেন, তাতে তা চূড়ান্ত ভারসামন্যহীনতা তৈরি করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।’ (সুরা কামার : ৪৯)। আল্লাহতায়ালা পৃথিবীকে মানুষের বসবাসস্থল ও তার জীবিকা অন্বেষণের জায়গা বানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’ (সুরা বাকারা : ৩৬)।

পারমাণবিক বর্জ্য প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে পারে : এ বৈশ্বিক সমস্যা শুধু বর্তমান মানবপ্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা আসন্ন প্রজন্মগুলোর জন্যও ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এসব সমস্যার কয়েকটিকে অনিবার্য বলে মনে হয়। এখনও পর্যন্ত এগুলোর উপযুক্ত সমাধান পাওয়া যায়নি। উদাহরণ হিসেবে পারমাণবিক বর্জ্যরে কথা বলা যায়। পারমাণবিক বর্জ্যে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা শত শত নয়, হাজার হাজার বছর পচনহীন থাকতে পারে। এমনকি তা মহাসাগরের গভীর তলদেশে সিমেন্ট ও সিসার কয়েক স্তর নিচে প্রোথিত থাকলেও। কারণ, সিমেন্ট ও সিসার এসব স্তর প্রবল চাপের নিচে ও পানির লবণাক্ততার মধ্যে শত শত ও হাজার হাজার বছর টিকে থাববে না। যে কোনো মুহূর্তে এ পারমাণবিক বর্জ্য প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে, তখন ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে।

প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সমস্যা : চারপাশের পরিবেশের সমস্যা শুধু প্রকৃতির উৎসগুলোর দূষণ ও তার থেকে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বিশুদ্ধ পানি দূষণের শিকার হচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানিকে সঠিক পন্থায় কাজে লাগানো হচ্ছে না। আমরা দেখছি, লাখ লাখ টন বিশুদ্ধ পানি সমুদ্রে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে।

যদিও মানুষ এসব অঞ্চলে পানির অভাবের সঙ্গে বসবাস করছে এবং তাদের বিশুদ্ধ পানির তীব্র প্রয়োজন রয়েছে। নির্মাণশিল্পের সম্প্রসারণের চাপে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে উর্বর ভূমি হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে উর্বর ভূমিকেও উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পন্থায় কাজে লাগানো হচ্ছে না। কৃষিকাজ চলছে প্রাচীন ও আদিম পদ্ধতি ব্যবহার করে। চাষ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নতি, বিভিন্ন ধরনের বীজের উন্নতি, মাটির ওপর চাপ এড়ানোর জন্য কৃষিচক্রের ব্যবস্থাপনা, জৈব সার ও সহায়ক উপাদান দিয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি- ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, সে সম্পর্কে এসব দেশ উদাসীন। সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির মতো বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বিশ্ব এখনও ধীরগতিতে এগুচ্ছে। বিশ্ব নির্ভর করছে যে কয় ধরনের শক্তির ওপর, প্রকৃতির ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব প্রমাণিত। শুধু তা-ই নয়, এগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে এবং মানুষের জীবনে ক্রমাগত ক্ষতি বৃদ্ধি করছে।

নবীজীবন প্রকৃতির অবদান ও শিক্ষায় পূর্ণ ছিল : এসব সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলাম অলসতা অবলম্বন করে দূরে থাকেনি। কারণ, এ ঐশী দ্বীনকে আল্লাহতায়ালা বিশ্বজগতের জন্য মনোনীত করেছেন। এ দ্বীনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, সামগ্রিকতা; এ পৃথিবীতে মানবজীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সক্ষমতা। এ দ্বীন বাস্তবিক অর্থে একজন মুসলমানের সমগ্র জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বল, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই। এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আনআম : ১৬২-১৬৩)। এ পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের দ্বারা আল্লাহতায়ালা নবুয়তের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তাঁর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বারা রাসুলদের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। এ দ্বীনের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম। ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদা : ৩)। নবীজি (সা.)-এর জীবন ছিল এ দ্বীনের সামগ্রিকতা ও পূর্ণতার বাস্তবিক প্রতিফলন। তার জীবন রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির পাশাপাশি চারপাশের প্রকৃতির প্রতি গুরুত্বের ক্ষেত্রেও অবদান, উপদেশ ও শিক্ষায় পরিপূর্ণ ছিল।

সামগ্রিক ঐশী মানহাজ এখন অবরুদ্ধ : ইসলাম তার সামগ্রিকতা ও পূর্ণাঙ্গতা সত্ত্বেও এখন নানা রকম হিংস্র আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইসলামের সঙ্গে সহিংসতা, সন্ত্রাস, জুলুম, নিষ্ঠুরতা, পশ্চাদপদতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর পরিবেশগত বিপর্যয়ে যদিও মুসলমানদের হাত নেই, যদিও বৈশ্বিক প্রভাবে তাদের কোনো ক্ষমতা নেই, শক্তি নেই, তারপরও ইসলামের ওপর আক্রমণ অব্যাহত আছে; বরং এ আক্রমণের হিংস্রতা ও নৃশংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। মানবতার যাবতীয় সমস্যার সমাধানে সক্ষম পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক ঐশী মানহাজ এখন অবরুদ্ধ, তাকে অবদান রাখার সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। তারা যদি পারত, তবে এ মানহাজের অস্তিত্বও টিকে থাকতে দিত না। আমাদের রব আল্লাহতায়ালা যেমন বলেছেন, ‘তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যে পর্যন্ত তোমাদের তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে না দেয়, যদি তারা সক্ষম হয়।’ (সুরা বাকারা : ২১৭)।

অনুবাদ : আবদুস সাত্তার আইনি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত