শৈল্পিক সাহিত্যে উপমাময় কোরআন

রিয়াদ এনাম

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পুরো পৃথিবীর সমগ্র সৌন্দর্য বুকে ধারণ করে আছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন। অভিনবত্বের এক বিরল ও জীবন্ত সৃষ্টি ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন। এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে ভাবনার প্রাণময় অতল স্নিগ্ধতা। যা প্রত্যাশার লালিত শুদ্ধস্বর ও মহাকালের কাঙ্ক্ষিত প্রার্থনাকে ত্বরিত টেনে আনে জীবনের দুয়ারে। পরম মুগ্ধতার সুরভি ছড়ায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে, মনন থেকে প্রাণের শুভ্র-সাদা কাশবনে। এর অবস্থান এত সমুন্নত যে, চিন্তার সজোর চলা ও দূরন্ত দৌড়ঝাঁপ এখানে এসে থমকে দাঁড়ায় বিজলীর মতো হঠাৎ। নিশ্চল হয়ে যায় অহমিকার সমূহ তোড়জোড়, হাঁকডাক। আত্মায় জাগিয়ে তোলে নৈসর্গিক প্রেরণা ও প্রীতির অচিন্তনীয় ভালো লাগা। পবিত্র আত্মার মানুষেরা এর দুর্দমনীয় চেতনাশক্তির বলেই কারও কাছে নত মুখ হওয়ার শিক্ষা পান না। এর শেকড় কারও প্রাণের ভূমিতে একবার গজালে তার জীবনের গতি আর কখনও শ্লথ হয় না। হতে পারে না। এটাই কি এর অলৌকিক হওয়ার বড় প্রমাণ নয়!

দুঃসাহস ও আত্মঘাতী সময়ে পথচলা : কোরআন তার সূচনালগ্ন থেকে অধুনার এ নাজুক সময় পর্যন্ত আপন চ্যালেঞ্জ ধরে রেখেছে সর্বতোভাবে। জিইয়ে রেখেছে সম্মান-ইজ্জত ও আপন শান-শওকত। এ যাবতকাল সামান্যতম কমতি গোচর হয়নি বিরোধী ও মোমিন বিশ্বাসীদের কাছে। ফেলে আসা সোনালি যুগে তার ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জে। কারণ, তার অভিযাত্রা শুরু এমন এক সময়ে, যখন সাহিত্য তার ভরা যৌবন পার করছিল। যে কাল সাহিত্যের উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির, বরং বলা চলে ইসলামপূর্ব যমানায় সাহিত্যের লাগাম ছিল পৌত্তলিক কবি-সাহিত্যিকদের হাতে ও তাদের পূর্ণ কর্তৃত্বে। তাদের কথাই ছিল, সাহিত্যের নীতি-প্রগতি, তাদের কবিতাই ছিল কাব্যের রস-রূপ ও শৈল্পিক কারুকার্য। তাদের প্রতিভাই ছিল সাহিত্যের সর্বোচ্চ মান্যবর আদালত। এর বাইরে কোনো কিছু কল্পনা করা ছিল রীতিমতো দুঃসাহস ও আত্মঘাতী। ঠিক সে সময়েই কোরআনের পথচলা শুরু। সর্বস্ব দিয়েও তারা এর মোকাবিলায় বেশিদূর এগোতে পারেনি।

আলোর পরশ পেয়ে গেয়ে উঠল : এমনকি অজ্ঞতার অন্ধকার কূপে তলিয়ে যাওয়া অসংখ্য কট্টর পৌত্তলিকও কোরআনের রূপ-সৌন্দর্যে আকুলিত হয়ে নির্জীব মাটির প্রতিমা পুঁজো থেকে চিরমুক্তি পেয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে ঈমানের সুশীতল শামিয়ানা তলে, একত্ববাদের বহমান মিছিলে। আর কোরআনের পবিত্র কথার অনুপম মাধুরি দিয়ে সজ্জিত করেছে জীবনের রওজা, হায়াতের গুলশান। আলো ছড়াতে ছড়াতে একসময় বর্বর, পিশাচ খ্যাত সেই অন্ধকার যুগের জাতিটিই পরিণত হলো পৃথিবীর সর্বসেরা সোনার মানুষে। স্নিগ্ধ প্রভাতের সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ল দিগদিগন্তে। আলোর পরশ পেয়ে গেয়ে উঠল বাগানের পাখি, অরণ্যের প্রাণী। চাঁদের আলো যেন তার কোমলকান্ত রূপ আবার ফিরে পেল। দিকে দিকে শুধু আল কোরআনের মাহাত্ম্য ও বড়ত্বের জয়ধ্বনি। মানুষের ঠোঁটে আসমানি কালামের সুর-লহরি বেজে উঠল। কোথাও বাকি রইল না এর গৌরবচিহ্নের আলোকপাত।

যেখানে মেলে ভাবনার অতল গহ্বর : এতেও কি স্পষ্ট হয় না, কোরআনই সমূহ সাহিত্যের উৎসমূল ও একমাত্র নির্ভরতার জায়গা। এখানেই ঘুরে-ফিরে মোড় নেয় সব রসবোধের নদ-নদী, তামাম ইনকিলাবের অববাহিকা। এখানে এসে মিলিত হয় ভাবনার অতল গহ্বরের সমুদয় আবেগ-অনুভূতি, দৃষ্টির রকমফের উপলব্ধি। যার ফলে শতাব্দীর বাঁকে বাঁকে শত আঘাতের পরেও মাথা উঁচিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে আল কোরআন। কোরআন যে সর্বযুগের, সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য একমাত্র দিকনির্ণয়ক- এ বিষয়টিও অনুমিত হয় কালান্তরের অনবদমিত তার অগ্রযাত্রা দেখে। মানুষের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা একাই শুষে নেওয়ার চাক্ষুষ প্রমাণের বদৌলতে। তা যে কোনো বোদ্ধা মানুষের বোঝার কথা, জানার কথা। যদি বুঝে না আসে, তাহলে নিজের বদ নসিবকে দোষারোপ না করে আর কি উপায় থাকতে পারে!

ওয়াহশির নির্দ্বিধ জবাব : কোরআন এমন সর্বস্বীকৃত একক অতুলনীয় গ্রন্থ, আজ পর্যন্ত কোনো শক্তিই তার চৌদ্দশ’ বছরের পুরোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস করতে পারেনি। কেননা, তার আবির্ভাব হয়েছে সাহিত্যের উর্বরতম ফসলা মাটির বুকে। যা এ পতনোন্মুখ সময়ে এসে কল্পনা করাও অনেকটা দুরূহ ব্যাপার। এ প্রেক্ষাপট বোঝাতে একটা দৃষ্টান্ত টানা অতীব জরুরি, আরবের মানুষেরা কেমন ক্ষুরধার প্রতিভাবান হতে পারে, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো- ওয়াহশি (রহ.) আরবের অখ্যাত, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতি সাধারণ একজন মানুষ। তার কাছে একদিন এক টগবগে তরুণ এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন দাদু?’

ওয়াহশির নির্দ্বিধ জবাব, ‘আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এক নারীর কোলে তোমার পা আমি দেখেছিলাম, তোমার শরীর চাদরে মোড়ানো ছিল। মনে হচ্ছে, সেই টুকটুকে বালকের পা দুটোই তোমার পা।’ বিষয়টা কতটুকু কল্পনাতীত কল্পনা করা যায়!

পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যের নমুনা : এত অভূতপূর্ব মেধা, এত সূচালো বুদ্ধির পরেও যখন সমগ্র আরব মিলেও এর কোনো বিকল্প খুঁজে পেল না। এ সাহিত্যে এসে স্থবির হয়ে গেল তাদের এ সুদীর্ঘ সময়ের ঊর্ধ্বগতি; তা আমাদের কাছে এ কথাই বলে যায় শুধু, আর কেউ কখনও কোরআনের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার শক্তি-সামর্থ্য কোনোটাই রাখে না। এটাই পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য। এটাই একমাত্র ভাষা-অলঙ্কারের নির্ভরশীল ঠিকানা। অতএব, যারা এ কোরআনের মৌলিক জ্ঞান রাখেন না, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। যদি কেউ এ পথে একাকী হাঁটতে শুরু করে, তাহলে নানা বিষয়ে ভুলের শিকার হবে। তাই আলেমবিহীন কারও হতে কোরআনের জ্ঞান আহরণে সবাই সতর্ক হবে।

আজমিরের চেয়ে শতগুণ সম্মানিত : আর সেই বর্ণনার মতো এমন অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যায় আরবদের তীক্ষè মেধার প্রখরতার গল্পে। তা ছাড়া নিজেদের ঘোড়ার খুর, এর বংশ-পরম্পরা, প্রতিটার নানারকম নামও সযত্নে মুখস্থ করার কাজে সিদ্ধহস্ত মানুষ ওরা। মেধার বিকাশে, রক্তের চরম উত্তাপে ওদের বেড়ে ওঠা। যুদ্ধে, মাঠে-ময়দানে, লোহার টুপি পড়ে ওরাই অর্ধজাহান শাসন করেছিল কয়েক শতাব্দী, বহুকাল। তাই যে কথা বলতে হবে, তা হলো- আরবরা মরে গেলেও আজমিরের চেয়ে শতগুণ ওপরে ও সম্মানিত। আর এ আরবদের সামনেই কোরআন মহিমার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল।

সাহিত্যের নানাদিক : বোধগম্য গদ্যে ও পরিচিত মিছাল টেনে কথা প্রকাশ করা আর এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে কেমন পছন্দসই ঢঙে, সাবলীল শব্দে বিবৃত হয়েছে একটু দেখুন; সুরা মারইয়ামে আছে, ইবরাহিম (আ.) দোয়ায় হাত তুলে বললেন, ‘হে আমার রব! তোমার পক্ষ হতে আমাকে দাও চোখ শীতল করা আওলাদ-ফরজন্দ। তাকে সহযোগী করে আমার যাবতীয় কাজ আসান করো। কেননা, আমি কমজোর হয়ে গেছি। আমার বাহুবল এখন নড়বড়ে। চুলে বার্ধক্যের ছাপ প্রকাশ পেয়েছে। আমায় রহম করো। দয়ার পরশ বুলাও। এর আগে তোমার কাছে এসে আমি রিক্তহস্তে ফিরে যাইনি কোনো দিন।’ (সুরা মারইয়াম : ৩-৪)। একবার ভেবে দেখুন, কত আবেগ এ মামুলি কথায়! নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে উপযোগী বাক্য আর কী-ই বা হতে পারে!

ভাব-অনুভূতির অপার খাজানা : চিন্তা-ফিকিরের সব ফর্মুলা মজুদ আছে কোরআনে। কোরআন একজন অবিশ্বাসীর অসার ভাবনা নিয়ে কী বলে দেখুন! পরলোকে বিশ্বাস করে না এমন লোকের জান্নাতে যাওয়ার দুরাশার চোরাবালি কত চমৎকার উপমায় তুলে ধরেছে ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন, ‘আমার আয়াত অস্বীকারকারী অহমিকায় ডুবন্ত কাফেরের জন্য আকাশের দরজা খোলা হবে না।

আমার জান্নাতে প্রবেশেরও কোনো সুযোগ তাদের নসিবে নেই; যতক্ষণ না সূচের ছিদ্রপথে ঘোড়ার প্রবেশ সম্ভবপর হয়ে ওঠে।’ অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমি তাদের কর্ম প্রতিদান বাতাসে ওড়া ধুলিকণায় পরিণত করব।’ (সুরা আরাফ : ৪০)। দুঃসাধ্য কাজ বলতে যা কিছু পৃথিবীতে আছে, তা বোঝাতে এর ওপর কোনো দৃষ্টান্ত আনার সুযোগ আছে? মানুষের ধারণার গতি যেখানে শেষ, সেখানেই উদয় হয় স্রষ্টার রহমতের সবুজ দূর্বাঘাস। রোদের আলোয় ঝিকিমিকি করে সেই ঘাসের চিরল বুক।

ধারেকাছেও নেই অন্যসব রূপ-রস : চিত্র প্রদানে কোরআনের রয়েছে এক সুনিপুণ ভূমিকা। যার কোনো নজির হয়তো বা পাওয়া যাবে না পুরো পৃথিবীর দেয়াল টপকে বা বিস্ময়ের আকাশ ছুঁয়ে দেখেও। কারণ, এটা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আমাদের জন্য বিশেষ উপহার ও অনুপ্রেরণামূলক সবচেয়ে বড় পাওয়া। এর অভিনব চিত্রগুলো মানুষের মনে এমনভাবে মুকুলিত হয়, যা মরণতক হৃদয়ে জমে থাকে শিশির বিন্দুর মতো।

আর ছবিতে দেখা চিত্র কখনোই বিস্মৃত হয় না; বরং তা জাগরূক থাকে ভাবনার রোদেলা উঠানে। আর যেহেতু কোরআন সচিত্র না হয়েও চিত্রবস্তুর চেয়ে বেশি স্থায়ী হয় মনের দহলিজে। তাই এটাই স্বভাবজাত কথা এবং এর অলৌকিকতা চির অনস্বীকার্য। কিছু চিত্র তুলে না ধরলে বিষয়টির গভীরতা কখনও বুঝে আসবে না। দেখুন কি বলে কোরআন একজন কাফেরের ব্যাপারে, ‘কাফেররা ওই ব্যক্তির মতো, যে এমন কোনো প্রাণীকে আহ্বান করে, যাদের কাছে সব কথাই কেবল চিৎকার-চেঁচামেচি। তারা বোবা, বধির ও অন্ধ; কিছুই বোঝে না, কোনো কথাই শোনে না!’ (সুরা বাকারা : ১৭১)। এখানে বাতিল উপাসনা ও উপাস্যের ব্যর্থতার যে স্বরূপ চিত্র অঙ্কন করা হলো শব্দের কারুকার্যে, তা কি কখনও ভোলা যাবে! কার সাধ্যি আছে এমন মূর্তমান কথার চিত্রিত উপমা তুলে ধরা দিবালোকে! এগুলো যখন চোখের সামনে আসে, তখন একজন আদনা ইনসানেরও বোঝার কথা কোরআনের সাহিত্য কতটা জীবনঘনিষ্ঠ ও সর্বমর্মী। কারণ, একটি লেখা ওই সময়ই স্বীকৃতি পায়, যখন তাতে ভাবনার পূর্ণ অস্তিত্ব ভেসে ওঠে। আর সে ক্ষেত্রে কোরআনের ধারেকাছেও নেই অন্যসব রূপ-রস, সাহিত্য। তাই কোরআনের সাহিত্যের কাছেই লুটে পড়ে বস্তুবাদী সব সাহিত্য ও শিল্প-সৌন্দর্য। এ ছাড়া যদি কারও সাধ জাগে এর সুরভিত বগানে হৈ চৈ সৃষ্টি করার, তাহলে দেখে নেওয়া ভালো অন্ধকার যুগের মানুষদের কী বেহাল দশা হয়েছিল। তখন সত্যিই নিভে যাবে এ সাময়িক উত্তেজনা।

পবিত্র আত্মায় অবগাহন করুন : কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে বেশ কিছু প্রাথমিক জ্ঞান একান্ত প্রয়োজন। যদি এটুকু জানাশোনা না থাকে, তবে পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যার তার কাছে কোরআনের জ্ঞান হাসিল করা না-মুনাসিব। বিদ্বান ও মুত্তাকি মানুষ খুঁজে শিখতে হবে এ প্রভূত ঐশী ইলম। আর এ জ্ঞানের জন্য কম করে হলেও বারোটি ইলমের পূর্ণ ধারণা থাকতে হবে।

যেমন- শব্দমূল, শব্দজ্ঞান, ব্যাকরণ বিদ্যা, অলঙ্কার গুণ, রুচিবোধ, অর্থবিদ্যা, ফিকহ, তাফসির, লৈখ্যরীতি, সাহিত্যধারা, বর্ণনারীতি। আরও নানা সহজ ও জটিল কিছু নৈমিত্তিক বিষয়; যা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর কোরআনের সৌন্দর্য, সাহিত্যশিল্প ও গভীর মর্মভেদী বিবরণ বোঝা সহজ হয়ে যাবে যদি কারও বিশ্বাস হয় অতীব আকর্ষণের ও ভালোবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তাই ভাষার এ সমৃদ্ধ ভুবনে প্রবেশের আগে অন্তত একবার নিজের বুদ্ধির ঝুড়িটা ভালো করে ঝেড়ে নিন। পবিত্র আত্মা নিয়ে অবগাহন করুন এ অতলান্ত জ্ঞানের অকূল সমুদ্রে।