মুসলমান ও প্রকৃতির বন্ধন

ড. রাগিব সারজানি

প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পাশ্চাত্যের লোকরা প্রাকৃতিক শক্তি কাজে লাগানোর ব্যাপারকে ‘প্রকৃতিকে জয় করা বা পরাভূত করা’ নামে আখ্যায়িত করতে অভ্যস্ত। তাদের এ অভিব্যক্তি থেকে বস্তুবাদী আদর্শের দৃষ্টিভঙ্গি কী, স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে এবং আল্লাহর ডাকে সাড়া দানকারী সৃষ্টিজগতের আত্মার সঙ্গে এ আদর্শের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে মুসলিমরা যাদের অন্তর পরম করুণাময় দয়ালু প্রতিপালকের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং যাদের আত্মা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর মহিমা ঘোষণাকারী এ অস্তিত্বের (সৃষ্টিজগতের) আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিশ্বাস করেন, কঠোর হওয়া ও পরাভূত করার সম্পর্ক ছাড়াও এখানে ভিন্ন একটি সম্পর্ক রয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহতায়ালাই এসব শক্তির উদ্ভাবক। যাবতীয় শক্তিকে তিনি একই রীতিতে সৃষ্টি করেছেন। যাতে তারা ওই রীতি অনুযায়ী তাদের জন্য নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পরস্পর সহযোগী হতে পারে। তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহতায়ালা এসব শক্তিকে শুরু থেকেই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। এসব শক্তির রহস্য উদ্ঘাটন ও নিয়মনীতি জানা তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা যখনই মানুষকে এসব শক্তির কোনো একটির সাহায্যে কোনো কাজ আঞ্জাম দেওয়ার সুযোগ দেন, মানুষের উচিত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কারণ, আল্লাহতায়ালাই এসব শক্তিকে মানুষের বশীভূত করে দিয়েছেন। মানুষের কোনো ক্ষমতা ছিল না এসব শক্তিকে বশীভূত করার। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা জাসিয়া : ১৩)। তাই অনুমান প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের প্রতি মানুষের অনুভূতিকে কিছুতেই পূর্ণতা দিতে পারে না। মানুষ ও প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের মধ্যে ভয়ানক ও বিপজ্জনক বলে কিছু নেই। মানুষ এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী। সে এক আল্লাহর ইবাদত করে। এক আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করে। আর এসব শক্তি মানুষের প্রতিপালকের সৃষ্টির অংশ। মানুষ এসব শক্তিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করে। সেগুলোর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে। এসব শক্তির রহস্য জানার চেষ্টা করে। ফলে প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ মানুষের সাহায্যে নিয়োজিত হয়। মানুষের সামনে তার রহস্যাবলি উন্মোচিত করে দেয়। এভাবে মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের সঙ্গে এক শৃঙ্খলিত বন্ধুত্বপূর্ণ মমতাময় জগতে বসবাস করে। (ফি যিলালিল কোরআন : ১/২৬)।

কোরআনুল কারিম ও নববি সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমরা দেখতে পাই, মানুষ ও তার চারপাশের প্রকৃতির মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান, তার কিছু দিক ও প্রকার রয়েছে।

১. খলিফা বা প্রতিনিধি সৃষ্টি : আল্লাহতায়ালা মানুষ সৃষ্টির আগে ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।’ (সুরা বাকারা : ৩০)। বিশিষ্ট মুফাসসিরদের তাফসিরে আয়াতে বর্ণিত ‘খলিফা’ শব্দের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, মানুষ প্রকৃতির শক্তিসমূহের ব্যবহারে ইচ্ছা স্বাধীন নয়। ইমাম বাগবি (রহ.) বলেন, ‘মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা; তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ও তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য।’ একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইবনে আতিয়্যা; তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে তা বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইজ্জ ইবনে আবদুস সালাম, কুরতুবি, বায়যাবি ও সিরাজুদ্দিন হাম্বলি (রহ.)। তিনি ‘খলিফা’ শব্দের ব্যাখ্যায় এ বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার দলিল হলো নবী দাউদ (আ.)-এর উদ্দেশ্যে আল্লাহর বাণী, ‘হে দাউদ, আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব, তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার করো ও খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’ (সুরা সোয়াদ : ২৬)।

পরবর্তীকালের মুফাসিসরদের মধ্যে যারা খলিফা শব্দের এ অর্থ করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন শায়খ রশিদ রেজা ও শায়খ সাইয়িদ তানতাবি প্রমুখ। পৃথিবীতে মানুষের খেলাফতপ্রাপ্তি তাকে প্রতিনিধি ও বিশ্বস্ত সংরক্ষক বানায়, মালিক নয়। তার জন্য আবশ্যক হলো, আমানতের হকসমূহ আদায় করা। যথার্থভাবে নেয়ামত উপভোগ করা। নেয়ামতদাতার যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যেহেতু তিনি নেয়ামতকে অব্যাহত রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন।

মানুষকে প্রতিনিধি ও খলিফা বানানোর মধ্যেই চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মৌলিক ও গূঢ়ার্থ নিহিত রয়েছে। খলিফা বানানোর অর্থ হলো, কোনো কিছুর অভিভাবক ও অসি নিযুক্ত করা। যার আবশ্যক দায়িত্ব হলো প্রযত্ন, সুরক্ষাদান ও আমানত বহন করা। মালিকানা বা হস্তক্ষেপে স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, এ ব্যাপারগুলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ প্রতিনিধিত্ব মানুষকে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক উৎসগুলোর ব্যাপারে আমানতদার বানিয়েছে। এগুলোতে তারা আল্লাহর হক সংরক্ষিত রাখবে। এগুলোরও হক আদায় করবে। একটি দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। তা হলো, এ সৃষ্টিজগতে মানুষের প্রথম যে সংজ্ঞা ও পরিচয় দেওয়া হয়েছে, তা তাকে পৃথিবীর বুকে খলিফা ও প্রতিনিধি বানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, মানুষের অস্তিত ¡লাভের আগেই আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে তার ভূমিকা কী হবে, তার প্রকৃতি নির্ধারণ ও সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। তা হলো, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব। এ বাস্তবতা মুসলিমদের মন ও মগজে একটি বিষয় বদ্ধমূল করে দিয়েছে, অর্থাৎ মৌলিকভাবে এ পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর ও এ পৃথিবীতে তাদের চলাফেলা ও আচার-আচরণ হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী।

২. পৃথিবীকে বসতিপূর্ণ ও আবাদ করা : এটিও সম্পর্কের একটি প্রকার। আল্লাহতায়ালা তাঁর নবী সালেহ (আ.)-এর জবানিতে যা বলেছেন, সেই বক্তব্য থেকে সম্পর্কের এ দিকটি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতেই তিনি তোমাদের বসবাস করিয়েছেন।’ যায়েদ ইবনে আসলাম বলেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের পৃথিবীতে বসবাস করতে যা কিছু প্রয়োজন তার নির্মাণ ও প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- বাড়িঘর নির্মাণ, গাছপালা রোপণ ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের মধ্যে পৃথিবী আবাদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। অর্থাৎ, তোমরা ফল-ফসল ফলাবে, গাছ রোপণ করবে, নদী-নালা খনন করবে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে। (আল জামিউ লি আহকামিল কোরআন : ৯/৫৬। )। পৃথিবীতে মানুষের প্রতিনিধি হওয়ার অন্যতম দাবি হলো, পৃথিবীকে আবাদ করা। ইবনে আবি হাতেম আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে আল্লাহতায়ালার বাণী ‘তাতেই তিনি তোমাদের বসবাস করিয়েছেন’র একটি ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি বানিয়েছেন। আয়াতে বর্ণিত শব্দগুলো থেকে বোঝা যায়, পৃথিবী আবাদ করা মানুষের জন্য আবশ্যক। কারণ, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সাধারণভাবে কোনো কিছু দাবি করা আবশ্যকতা নির্দেশ করে। (আল জামিউ লি আহকামিল কোরআন : ৯/৫৬)।

উপর্যুক্ত বক্তব্যের ওপর ভিত্তির করে আল্লামা জামখশারি পৃথিবীর আবাদকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, আবাদকরণ চার প্রকারের : ১. ওয়াজিব বা আবশ্যক; ২. মানদুব বা প্রতিনিধিত্বশীল; ৩. মুবাহ বা অনুমোদিত এবং ৪. মাকরুহ বা অপছন্দনীয়।

তিনি উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীকে আবাদকরণ মানুষের দীর্ঘজীবি হওয়ার কারণ। তিনি বর্ণনা করেছেন, পারস্যের নৃপতিরা বিপুল পরিমাণে নদী-নালা খনন করেছিল এবং গাছ রোপণ করেছিল। ফলে তারা দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিল। যদিও তারা প্রজাদের ওপর জুলুম ও নিপীড়ন করত। ওই যুগের একজন নবী তাঁর প্রতিপালকে নৃপতিদের দীর্ঘজীবি হওয়ার কারণ কী, তা জিজ্ঞেস করেন। জবাবে তার প্রতি অহি প্রেরিত হয়, ‘তারা আমার দেশকে আবাদ করেছে, ফলে সেখানে আমার বান্দারা বসবাস করেছে।’ (তাফসিরে কাশশাফ)।

অনুবাদ : আবদুস সাত্তার আইনী