কোনো কাজটি পাপের আর কোনটি পুণ্যের, তার অনেকগুলোই বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়। সে যোগ্যতা আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের মধ্যে দিয়ে রেখেছেন। যেমন- চুরি-ডাকাতি, খুনখারাবি, জিনা-ব্যভিচার, গালিগালাজ ইত্যাদি। এগুলো যে পাপের কাজ, তা কাউকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হয় না। ব্যক্তি নিজের সুস্থ বিবেক দ্বারাই এসবের কদর্যতা বুঝতে পারে। তবে কিছু কিছু কাজের মন্দ দিকগুলো শরিয়তের পক্ষ থেকে মানুষকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দিলে সেগুলোর খারাবি তারা জানতে পারে বা বুঝতে পারে। যেমন- সুদ-ঘুষ, জুয়া, কেনাবেচা সংক্রান্ত অবৈধ বিষয়াবলী, বিয়ে ও তালাক সম্পর্কিত অবৈধ বিষয়াবলি ইত্যাদি। যেভাবেই হোক, আমরা জানতে পারি- আমাদের কোন কাজটি গোনাহের আর কোনটি সওয়াবের! কোনটি করা ঠিক আর কোনটি করা ঠিক নয়! এরপরও আমরা পাপ করি। গোনাহের কাজে জড়িত হই। জেনে-বুঝে বারবার অপরাধে লিপ্ত হই। এসব আসলে কেন হচ্ছে! কেন আমরা বারবার তওবা করেও পাপ থেকে বিরত থাকতে পারছি না? সে কারণগুলো জানা দরকার। খুঁজে বের করে আমল করা দরকার। সেগুলো হলো-
কলবের অসুস্থতা : আমাদের কলব বা অন্তর অসুস্থ, দুর্বল। পাপের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো যে কলব থাকা দরকার, তা আমাদের নেই। কলবের খাবার আছে। কলবের যত্ন আছে। আমরা কলবকে সে খাদ্যগুলো দিই না, কলবের পরিচর্যা করি না। যে কারণে তার বেহাল দশা। সে খাবার হলো জিকির, তেলাওয়াত, আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন ইত্যাদি। আর পরিচর্যা হলো, আল্লাহওয়ালাদের সান্নিধ্য গ্রহণ করে কলবের চিকিৎসাকরণ।
দৃঢ় সংকল্পের অভাব : পাপ ছাড়ার জন্য হিম্মত লাগে। মনের দৃঢ় ইচ্ছা লাগে। সে ইচ্ছা আর হিম্মত করি না। মনে করি, পাপ করতে থাকি। আল্লাহ তো দয়ার সাগর। তিনি তো ক্ষমা করবেনই। তওবা করলে তো সব মাফ হবে। ইত্যাদি চিন্তাভাবনার কারণে আমরা ঠিকমতো পাপ ছাড়ার হিম্মত করি না। সেজন্য পাপও ছাড়া হয় না। এমন দুর্বল মোমিনকে ইসলাম ছোট দৃষ্টিতে দেখে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শক্তিশালী মোমিন দুর্বল মোমিন থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও উত্তম।’ (মুসলিম : ৪৮২২)। কারণ, মোমিন শক্তিশালী অন্তরের অধিকারী হলে অনেক সময় গোনাহকে সে নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দিতে পারে। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি গোনাহের সংকল্প করে তা বাস্তবায়িত করে না, আল্লাহ তার জন্য একটি পূর্ণ নেকি লিখে দেন।’ (মুসলিম : ১৩১)। আবার অনেক সময় পাপকে ছোট ভাবতে থাকি। সগিরা-কবিরা বলে ভাগ করে ফেলি। যে কারণে হিম্মতে ঘাটতি আসে। কিন্তু পাপ তো পাপই। সে ছোট কী আর বড় কী! সে তো আমার জীবনের পরম শত্রু। সে আমার সর্বনাশ করবে, এটা ভাবি না। হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা অতি ছোট পাপ থেকেও বেঁচে থাক।’ (সহিহুল জামে : ২৬৮৬)।
চেষ্টার অভাব : চেষ্টা ছাড়া কোনো বস্তু হাসিল করা সম্ভব নয়। তেমনি গোনাহ ছাড়ার জন্যও এর বিকল্প নেই। ইউসুফ (আ.)-এর কথা ভাবুন। জুলাইখা যখন তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছিল এবং নির্জনকক্ষে তার রূপ-লাবণ্য প্রদর্শন করে খাহেশ মেটাতে চাচ্ছিল, এদিকে আবার বাইরে থেকে সাত-সাতটি গেট থালাবদ্ধ করে দিয়েছিল, তখন ইউসুফ (আ.)-এর কী করার ছিল! এরপরও তিনি চেষ্টা করেছেন। দরজার দিকে দৌড় দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালাও তখন সাহায্য করেছেন। এক-এক করে সাতটি দরজা ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল। আর তিনিও ব্যভিচারের মতো জঘন্য পাপ থেকে বেঁচে যান। সুতরাং, পাপ ছাড়ার জন্য আমাদের চেষ্টা-সাধনা থাকা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আমার পথে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়, তাদের অবশ্যই আমি আমার পথে পরিচালিত করি। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে থাকেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)।
লজ্জাহীনতা : লজ্জা মোমিনের চারিত্রিক ভূষণ। এটি তার ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতা দান করে। হাদিসে এসেছে, ‘যখন তোমার লজ্জা থাকে না, তখন যা খুশি তা কর।’ (বোখারি : ৬১২০)। অন্য হাদিস এসেছে, ‘আল্লাহকে সেভাবে লজ্জা কর, যেভাবে তোমার কওমের নেক মানুষকে লজ্জা করে থাক।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান : ৭৭৩৮)। সুতরাং, কোনো ব্যক্তি যদি পাপ করার সময় এভাবে চিন্তা করে, আমার পাপের কথা আমার মা-বাবা, উস্তাদ বা বড়রা জানলে অবস্থা কেমন হবে! তখন লজ্জা আসবে এবং পাপ থেকে বাঁচাও সম্ভব হবে।
পর্দাহীনতা : পর্দা একটি ফরজ বিধান। অথচ আমরা একে কিছু মনে করি না। অনেক মাহরাম নারী যাদের সঙ্গে শরিয়ত বিয়ে বৈধ রেখেছে, তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে পর্দা ছেড়ে দিই। এটা খুবই দুঃখজনক। এটা যে গোনাহ, অনেকে তাও ভাবি না। এভাবেই গোনাহের পাল্লা ভারি হচ্ছে। স্মরণ রাখবেন, পর্দা হলো নারী-সংক্রান্ত গোনাহ থেকে বাঁচার একটি দেয়াল। এ দেয়াল যার যত মজবুত থাকবে, সে গোনাহ থেকে তত আত্মরক্ষা করতে পারবে।
পাপের পরিণতি না ভাবা : প্রত্যেকটি পাপের একটি খারাপ প্রতিক্রিয়া আছে। আপনি যেমন কাজ করবেন, তেমন ফল পাবেন। সেটাই আল্লাহর বিধান। ভালো করলে যেমন ভালো পরিণতি হবে, তেমন মন্দ
করলেও মন্দ পরিণতি হবে। সে পরিণতি দুনিয়াতেও ভোগ করতে হবে, পরকালেও ভোগ করতে হবে। এমননকি আপনি কারও ইজ্জত নষ্ট করলে আপনার ইজ্জত আল্লাহ অন্য কাউকে দিয়ে নষ্ট করবেন। আপনি কারো মা-বোন কিংবা স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করলে সেই কাজ আপনার লোকদের সঙ্গেও কেউ করবে। এককথায়, যেমন কর্ম তেমন ফল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মন্দ উপার্জন করবে, প্রতিটি মন্দের প্রতিদান হবে তারই অনুরূপ (মন্দ দিয়ে)। আর তাদের আচ্ছন্ন করবে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা (দুনিয়া ও আখেরাতে)।’ (সুরা ইউনুস : ২৭)।
এছাড়া নানা আজাব-গজব তো আছেই, যা ব্যক্তির শারীরিক, আর্থিক ক্ষতি সাধন করবে। আমরা পাপের সেই পরিণতির কথা বেমালুম ভুলে যাই। সেজন্য পাপ ছাড়তে পারি না।
পাপের উপকরণ এড়িয়ে না চলা : কিছু ভাই বলেন, ‘পাপের ভেতরে থেকে পাপ না করলে সেটা হলো বড় বুজুর্গি।’ এ ভেবে তারা পাপের উপকরণ থেকে দূরে থাকতে চান না। ফলে ঠিকই তারা পাপে জড়িয়ে যান। এটাও শয়তানের ধোঁকা। পাপের উৎস থেকে অবশ্যই একজন মোমিনকে দূরে থাকতে হবে। গানের আসর জমেছে আর আপনি সেখানে গিয়ে বসে থেকে যদি বলেন, ‘এ গান যদি আমি না শুনি, তাহলেই তো বুজুর্গি।’ এটা কোনো কথা নয়! কোরআন তার উল্টোটা বলে। কোরআন বলে, যদি আপনি এ ধরণের কোনো পরিবেশে পড়ে যান, তাহলে ভদ্রতার সঙ্গে এড়িয়ে যাবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(রাহমানের বান্দা তারাই) যখন তারা অনর্থক কথা বা কর্মের পাশ দিয়ে চলে, তখন সসম্মানে চলে যায়।’ (সুরা ফোরকান : ৭২)।
খারাপ সঙ্গ ত্যাগ না করা : খারাপ বন্ধু বিষাক্ত সাপের চেয়েও খারাপ। তাই খারাপ বা দুষ্টু বন্ধুদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা চাই। এটা করতে পারি না বলে তাদের কারণে আমরা নানা পাপে জড়িয়ে পড়ি। হাশরের মাঠে মানুষ এ জন্য আক্ষেপ করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(সেদিন মানুষ আফসোস করে বলবে) ‘হায়! যদি অমুককে আমার বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!’ (সুরা ফোরকান : ২৮)। হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। তাই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য রাখে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৮৩৩)।
দুনিয়ার আসক্তি : দুনিয়ায় জীবনযাপনের জন্য যতটুকু ধনসম্পদ, রসদপত্র দরকার, ততটুকু অন্বেষণ, উপার্জন মন্দ নয়; বরং ফরজ দায়িত্ব। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে দুনিয়ার প্রতি চরম আসক্ত হয়ে যাওয়া, যার ফলে দ্বীনধর্মের ক্ষতি হয়, সেটি নিন্দনীয়। কারণ, এর ফলে ব্যক্তি অন্যায়ের পথে হাঁটতে থাকে। তাই নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘(সাবধান!) দুনিয়ার ভালোবাসাই সকল পাপের মূল।’ (কানজুল উম্মাল : ৬১১৪)। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘দুনিয়ার জীবনকে ক্রীড়া-কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, পারস্পরিক গর্ব-অহংকার প্রদর্শন আর ধনসম্পদ ও সন্তানাদিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা বলা হয়েছে। সর্বোপরি তাকে ধোঁকার সামগ্রী বলা হয়েছে।’ (সুরা হাদিদ : ২০)। এক হাদিসে দুনিয়াকে ছোট কানওয়ালা মৃত ছাগলছানার সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়েছে। (মুসলিম : ২৯৫৭)। আরেক হাদিসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, ‘দুনিয়ায় থাক মুসাফির অথবা পথচারীর মতো।’ (বোখারি : ৬৪১৬)।
তাকওয়াব বড় অভাব : তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয়, মরণের ভয়, কবর-হাশর-পুলসিরাতের ভয়, জাহান্নামের শাস্তির ভয়। এত সব ভয়ের কারণে নিজেকে যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখার নামই তাকওয়া। এর স্বরূপ সম্পর্কে একবার ওমর (রা.) উবাই বিন কাব (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘হে ওমর! মনে কর পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন। মাঝখানে সরুপথ। সে পথ তোমাকে পেরুতে হবে। এখন তুমি কীভাবে পেরুবে?’ ওমর (রা.) বললেন, ‘খুব সাবধানে! গায়ে যেন কাঁটা না বিঁধে।’ তিনি বললেন, ‘এরই নাম তাকওয়া।’ দুনিয়ায় যত অপরাধ সংঘটিত হয়, তার সবই হয় তাকওয়ার অভাব্লে। এ গুণটির কারণে মোমিনের ঈমানে তারতম্য হয়। একজনের মর্যাদা অন্যজনের তুলনায় বেড়ে যায়। একজন আরেকজনের তুলনায় আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় হয়। আবার এ গুণটির অভাবে মানুষ মনুষ্যত্ব হারায়। ইতর শ্রেণিতে পরিণত হয়। সে আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে এমন জঘন্য কাজ করে, যার কারণে সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। দুনিয়ায় সেই ব্যক্তি তত বড় বুজুর্গ, যার তাকওয়া যত বেশি। তাই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় কর। আর প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মুত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০২)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া সিদ্দিকিয়া কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ