নির্মল পরিবেশ গড়ুন

মাইমুন রাফি

প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পরিবেশ যত সুন্দর হয়, মানুষ তত রুচিশীল হয়। মানব জীবনের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে পরিবেশের বড় অবদান। আবার পরিবেশ যখন দূষণ ও অসহনীয় হয়, তখন তা অকল্যাণ বয়ে আনে। জীবনের সব সৌন্দর্য নস্যাৎ হয়। পরিবেশ দ্বারা আমরা প্রভাবিত। পরিবেশের মনোরম স্নিগ্ধতা আমাদের সভ্যতার সোপানে নিয়ে যায়। আবার কখনও পরিবেশের দুর্গতির কারণে জীবনে নেমে আসে হাজারো যাতনা। পরিবেশের নোংরামি ও অপরিচ্ছনতায় জীবন হয় চরম দুর্ভোগের। তাই পরিবেশ অনুকূল করা বা সুন্দর ও পরিপাটি পরিবেশ তৈরি করা যেমন কল্যাণপ্রসূ হয়, তেমনই তা জীবনকে পরিশীলিত করে তোলে।

পরিবেশ ও প্রকৃতি আল্লাহর দান : ভুবনজুড়ে আমাদের জীবন ঘিরে অপার্থিব ভালোলাগা এক প্রকৃতি রয়েছে। যে প্রকৃতি আমাদের মোহিত করে। আমাদের সুবাসিত করে। আলোকিত করে আমাদের চারপাশ। মুগ্ধ করে তার অপরূপ সৌন্দর্যে। এগুলো মহান আল্লাহর দান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কী দেখে না উটকে, কীভাবে সৃষ্টি করা হলো! কীভাবে আসমানকে সমুচ্চিত করা হলো! কীভাবে পাহাড়-পর্বতকে স্থাপন করা হলো! পৃথিবীকে কীভাবে বিস্তৃত করা হলো!’ (সুরা গাশিয়া : ১৭-২০)। তিনি এগুলোকে আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আমাদের উপকারের জন্য দিয়েছেন। সর্বদা আমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। কোরআনে কারিমে বিভিন্ন স্থানে তা উল্লেখ করেছেন।

ইসলামে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব : ইসলাম মানুষের মুক্তির পথ। ইসলামের ছায়াতলে রয়েছে মানুষের সরল পথের রাহনুমা। ইসলাম আমাদের রুচি শেখায়। কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপ থেকে আমাদের বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। আমাদের পরিপাটি হয়ে চলতে বলে। আমাদের চারপাশকে পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখার বার্তা দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ঘরবাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করে রাখো।’ (মুসনাদুল বাজ্জার : ১১১৪)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম; তিনি (সবকিছুতে) উত্তম পন্থা পছন্দ করেন। তিনি পরিচ্ছন্ন; তিনি পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তিনি সম্মানিত; তিনি সম্মান করা পছন্দ করেন। তিনি দয়াশীল; তিনি দান করা পছন্দ করেন। সুতরাং তোমরা পরিষ্কার করো।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)। জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের বাড়ি পরিদর্শন করার জন্য এলেন। তিনি একজন লোককে দেখলেন। তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘সে কী তার চুল সুন্দর করে রাখার কিছুই পায় না?’ তিনি আরেকজনকে দেখলেন, যার গায়ে ময়লা কাপড় ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তার কাপড় পরিষ্কার করার কিছুই নেই?’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৪৮৩)।

অন্যায় ও অশ্লীলতায় পরিবেশ ধ্বংস হয় : ভালো স্বভাব একটি আদর্শ পরিবেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মন্দের সয়লাব পরিবেশকে কলুষতাযুক্ত ও কদর্যপূর্ণ করে তোলে। আশপাশ যেমন মনোরমপূর্ণ ও নয়নাভিরাম হলে মনে প্রফুল্লতা থাকে, তেমনই চরিত্রে ও ব্যবহারে মাধুর্যতা, শালীনতা, পঙ্কিলতাহীনতার সমাবেশ হলে পরিবেশ তখন মানুষের মাঝে নিয়ে আসে শান্তি-মমতা, ভাতৃত্ব ও একতা। মানুষের মাঝে যখন হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিদ্বেষ, পরনিন্দা-হেনস্থা করার মতো মন্দ চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন সবদিকে চলে লুটতরাজ, হানাহানি, কাদা ছোঁড়াছুড়ি। ইসলাম এগুলো থেকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে নিয়ে পরিহাস কোরো না।’ (সুরা হুজুরাত : ১১)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের একে অপরের গিবত ও দোষ খোঁজাখুঁজি কোরো না।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে রাখা ঈমানের অংশ : আমরা চাই আমাদের পরিবেশ মনোমুগ্ধকর হবে। অন্যদের কাছে প্রশংসনীয় হবে। আমাদের রুচিসম্মত হবে। আমাদের জন্য সমূহ কল্যাণের কারণ হবে। সে জন্য প্রয়োজন কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের। সমাজের কষ্টদায়ক, অসঙ্গতিপূর্ণ কাজগুলো মূলোৎপাটন করা চাই। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অমার্জিত, অপমানজনক কাজ এড়িয়ে চলা উচিত। পরস্পর সম্মানবোধ তৈরি করা, দয়াপরবশ আচরণ করা, অন্যের জন্য কষ্ট হয়, এমন সব অপরাধ ও অসঙ্গতি চিহ্নিত করে তা শোধরানোর প্রয়াস চালানো কর্তব্য। তাহলে সম্ভব জাতিকে আদর্শ পরিবেশ, উত্তম সমাজ উপহার দেওয়া। জীবনের সঙ্গে অতি কাছাকাছি ঘটে যাওয়া সব কার্যকলাপগুলো অন্যের জন্য কষ্টের কারণ না হওয়া। কখনও হলে ক্ষমা চাওয়া। আমরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিছু খেয়ে ঝুটা ময়লা রাখার স্থানে না ফেলে এদিক সেদিক তাকিয়ে পাশেই কোথায় ছুঁড়ে মারি বা ফেলে রাখি। যা অন্যদের কষ্টের কারণ। কখনও পিছল জাতীয় কিছু হলে পথিকের অসতর্কতায় তার সর্বনাশ ডেকে আনে। ইসলামের শিক্ষা এ ক্ষেত্রে খুবই সুন্দর। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরের চেয়ে বেশি শাখা রয়েছে। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে রাখাও ঈমানের শাখা।’ (মুসনাদে আহমদ : ৯৭৪৮)।

 

শব্দদূষণ ইসলাম সমর্থিত নয় : আমরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে নানা সভা-সমাবেশ করি। তাতে রাত দীর্ঘ করি। অথচ সমাবেশের পাশে যেসব অধিবাসী রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকের মাইকের বিকট আওয়াজে ঘুমের ব্যঘাত হয়। আমরা চাইলে কিন্তু আওয়াজ প্রয়োজন অনুযায়ী কমাতে পারি। কিন্তু সেটা করি না। মানুষের কষ্টের কথা ভুলে যাই। তাদের যে অসহনীয় পর্যায়ে ক্ষতি পৌঁছেছে, তা উপলব্ধি করি না। ইসলাম এ সকল মর্মান্তুক বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কারও ক্ষতি ও অনিষ্ট সাধন করা যাবে না।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ২৭৫৮)। পথে বেরুলে প্রায়শই রাস্তা ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও হর্ন বাজানো হচ্ছে। অনর্থক কাজ ছাড়া এগুলোকে আর কী বলা যায়! যেখানে প্রয়োজন, সেখানে তো সমস্যা নেই। এটা কোনো ভদ্র ও সভ্য মানুষের পরিচয় বহন করে না। হর্নের বিকট শব্দ খুবই অসহনীয় আওয়াজ। আমাদের উচিত, তা বর্জন করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা উত্তম মুসলমানের পরিচয়।’ (মুসনাদে ইবনুল জাদ : ২৯২৫)।

পথঘাটে ন্যক্কারজনক ও দৃষ্টিকটু পরিবেশে করণীয় : বাসা-বাড়িতে, অফিস-আদালতে, লঞ্চণ্ডবাসে কখনও এমন ন্যক্কারজনক ও দৃষ্টিকটু পরিবেশ দেখা যায়, যা হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক। অনেক ক্ষেত্রে নিজের মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্যের ওপর অবিচার করে ফেলি। তখন কেউ কোমলতা প্রদর্শন করতে চায় না। অথচ একপক্ষ নীরব হয়ে গেলে অপর সরব পক্ষ থেমে যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আয়েশা! কোমল হও। জেনে রাখো, যেখানে কোমলতা থাকে, তা সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়। আর যেখানে কোমলতা প্রদর্শিত হয় না, সেখানে বিষয়টিকে আরও দোষযুক্ত করা হয়।’ (মুসনাদে আবি দাউদ : ১৬১৯)।