আগুন রাঙা ফাগুন

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ধূসর প্রকৃতি সেজেছে এখন গাঢ় লালে। যেদিকে চোখ যায়, শুধুই উজ্জ্বল লালের সমারোহ। গা জুড়িয়ে যাওয়া বসন্তের বাতাসে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শিমুল ফুল। রক্তিম শিমুল ছড়ানো সে পথে হেঁটে যেতে শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির। আজ পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন। কবির সেই চিরায়ত বাণী ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ অথবা ‘আহা, আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়’। আবহমান বাংলার ঋতু-বৈচিত্র্যের উল্লেখযোগ্য ঋতু বসন্ত। তাই এ ঋতুকে বলা হয় ঋতুরাজ। বঙ্গাব্দের শেষ দু’মাস ফাল্গুন ও চৈত্র মিলে বসন্ত ঋতু। বাংলার প্রকৃতি, আমাদের ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বড় স্থান দখল করে আছে বসন্ত। বসন্ত মিলনের ঋতু, আবার বিরহেরও ঋতু। শীতের জবুথবু প্রকৃতির অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ সমীরণের প্রবাহ শুরু হয় বসন্তে। এর সঙ্গে দোলায়িত হয় মানুষের মন। জীবন রসায়নে যেন কী এক পরিবর্তন আসে। হৃদয়ে সৃষ্টি হয় প্রণোদনা। নাড়া দেয় এক অব্যক্ত আবহ। শুধু মানব-মানবীর মনেই নয়; বৃক্ষরাজি, পাখি ও প্রাণিকূলেও এ হাওয়া দোলা দেয়। কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরাপাতার শুকনো নূপুরের নিক্কন, প্রকৃতির মিলন এ বসন্তেই।

বসন্ত নতুন প্রাণের কলরব : ফুল ফোটার পুলকিত এ দিনে বন-বনান্তে, কাননে-কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহলে ভরে ওঠে চারদিক। কচিপাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলের কুহুকুহু ডাক ব্যাকুল করে তোলে অন্তর। শুধু মিলনই তো নয়, প্রেমের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে নানা রকম শঙ্কা-সন্দেহ। এমন মধুর দিনে কবি বলেছেন, ‘সে কি আমায় নেবে চিনে, এই নব ফাল্গুনের দিনে- জানি নে?’ অথবা ‘রোদন ভরা এ বসন্ত, সখী বুঝিনি কখনও আগে/ মোর বিরহ বেদনা জাগিল কিংশুক রক্তিম রাগে’। এ সময়েই শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচিপাতার ধীরগতিতে বাতাসের সঙ্গে বয়ে চলা জানান দেয় নতুন কিছুর। শীতের খোলসে ঢুকে থাকা বন-বনানী অলৌকিক স্পর্শে জেগে ওঠে। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। এ সাজে মন রাঙিয়ে গুন গুন করে অনেকেই গেয়ে ওঠে- ‘মনেতে ফাগুন এলো’ অথবা ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে গানগুলি বাঁধিলাম ছন্দে ছন্দে’।

প্রকৃতিতে এসেছে ভিন্নতার ছোঁয়া : ফাগুন এসেছে প্রকৃতিতে। বলা হয় ‘ফাগুন মাসে আগুন ঝরে’। আসলেও তাই। ফাগুনের এ দিনগুলোতে সূর্যের তাপের প্রখরতা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি গাছপালাগুলো হয়ে যায় পাতাশূন্য। বসন্তের এ লগ্নে পাতাশূন্য গাছগুলো যেন ঠাঁয় এক পায়ে নিস্তব্ধ-নীরব হয়ে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ, বসন্তে সে তার রূপ-লাবণ্য হারিয়ে আবার নব যৌবনের অপেক্ষায় থাকে। প্রতীক্ষায় থাকে মানুষের মনে দৃষ্টি নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগাতে। ঋতুবদলের পালাক্রমে প্রকৃতিতে আসে ভিন্নতার ছোঁয়া। গাছে গাছে ফোটে নানা রকম ফুল। হরেক রকম ফুলের সুবাস ভেসে আসে বাতাসে। আর সেই ফুলের সুবাসে মন মাতোয়ারা হয়ে যায়। প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। অজানা এক আনন্দ জায়গা করে নেয় মনের কোনে। হৃদয়ে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ বয়ে যায়। মাঠ-ঘাট শুকনো চাদরে ঢাকা থাকে। মেঘ থাকলেও বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। সূর্যের আলোর রুক্ষèতায় ঘাম ঝরে জমিতে কাজ করা কৃষকের। ঘাম ঝরে যেন বৃষ্টির পানি গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ার মতো। তবুও সূর্যের রুক্ষèতা যেন একটুখানিও ম্লান হতে চায় না। ফাগুনের সূর্য যেন তার রূপ-তেজ দেখাতেই বেশি ব্যস্ত। তার আলোর ঝলকানিতে গরমে ক্লান্ত মানুষজন। তবুও তার একটুখানি মায়া নেই সেই তপ্ত-রুক্ষè মরুর সূর্যের মতো। যা মরুর বালুকে পরিণত করে উত্তপ্ত গলিত লাভার ন্যায় তেজস্বী আর উষ্ণ।

ফাগুন দিনের পড়ন্ত বেলা : গাছে গাছে ফোটে গোলাপ-গাঁদা-বেলি। ছড়ায় মন ভোলানো সুবাস। উষ্ণতার চাদর ভেদ করে সেই ফুলের সুবাস ভেসে আসা বাতাস যেন গায়ে একটুখানি শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। তপ্ত রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কৃষকের পা যেন পুড়ে যায়। তবু সে পথেই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে যাত্রা করে কৃষক। মাঠে-মাঠে হাওয়ার দোলানিতে দোলে সোনার ফসল। সব ক্লান্তি ভুলে এক মুহূর্তের জন্য কৃষক যেন বুঁদ হয়ে থাকে তার সোনার ফসলের দোলার সেই মুগ্ধতায়। ফাগুনের দিনে পড়ন্ত বেলায় ঘুরতে বেরুলেই দেখা মেলে ফাগুনের চির অনিন্দ সৌন্দর্যের। পাতাশূন্য গাছগুলো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে যেন আনমনা হয়ে আছে। কেউ তার প্রশংসা করে না, কেউ তার দিকে মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকায় না; তাই তার মন খারাপ। তবুও নব যৌবনের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে সে। হরেক রকমের পাখির বাসা তার ডালে। পাতাশূন্য হয়ে যাওয়ায় পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখির বাসাগুলো যেন আর লুকোচুরি খেলতে পারছে না। পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা দেখে ফেলবে তাদের বাসা। আর একদিন ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে তার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো। এ আশঙ্কায় পাখি এ গাছ ছেড়ে অন্য গাছে বাসা বাঁধার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই গাছের মন খারাপ। ফাগুনের পড়ন্ত বিকেলে এমন মন ভোলানো দৃশ্যের দেখা মেলে অপার সবুজের পল্লি-গাঁয়ে।

উদাস বসন্ত প্রেম-প্রকৃতি : ফাল্গুনী মাতাল হাওয়ায় উদাস বসন্ত প্রেম-প্রকৃতিকে ভাবায়, তাড়িত করে। সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী কবি খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের দিকে অদ্ভুতভাবে অনুভব করেছেন বসন্তকে। এরপর বিভিন্ন কালে প্রকৃতির মতো কবিতায়ও রূপ বদলেছে বসন্ত। রবীন্দ্রনাথের রোদনভরা বসন্ত নজরুলে এসে হয়েছে ‘আসিবে তুমি জানি প্রিয়/ আনন্দে বনে বসন্ত এলো/ ভুবন হলো সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর’। বলা যায়, এখন ধরায় প্রেম ও প্রকৃতির কবি নজরুলের এ গানের সুর ছড়িয়ে দুয়ারে আবার এসেছে ফুলেল, মধুময় যৌবনের বসন্ত। প্রকৃতিজুড়েও চলবে নিজস্ব উদযাপন। ভরদুপুরে শুকনো পাতার হৃদয়ভাঙা মর্মর ধ্বনি, পাতা ওড়ানো বিরহী ফাল্গুনী বাতাস, ন্যাড়া ডালের হৃদয় খুঁড়ে সবুজ প্রাণের উঁকি, শিমুল-পলাশের রক্তিম আভা, কোকিলের অবিরাম সঙ্গী সন্ধান ধরায় জানান দেবে, বসন্ত এসে গেছে।

পোশাক আর ফাগুনের ফুলের সাজ : ‘জ্বালাইলে না জ্বলে আগুন। নেভানো ভীষণ দায়। আগুন জ্বালাইস না আমার গায়’। চিরন্তন এ গানের সুরে সুরে আবার এলো ফাগুন। ফাগুনের আগুন রাঙা সাজে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে নানা দিকে থাকে তাই আয়োজন। বেশ কয়েক বছর ধরেই অন্যান্য উৎসবের মতোই ফাগুনেও রং মিলিয়ে নতুন পোশাক কেনার প্রচলন শুরু হয়েছে। হলুদ, বাসন্তী রঙের পোশাক আর ফাগুনের নানা ফুলের সাজে এ দিন প্রত্যেক নারীই হয়ে ওঠেন অনন্যা। শুধু সুন্দর পোশাক পরলেই তো হবে না, সেই সঙ্গে মনের সাজটাও হতে হবে মানানসই। ‘হে কবি! নীরব কেন? ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?’ কবি বেগম সুফিয়া কামাল বসন্তের আবেদনকে এভাবেই তুলে ধরেছেন। আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/ আজ বসন্ত’।

বসন্ত তারুণ্যের উৎসব : বসন্তে তারুণ্য-মনে বেজে ওঠে কবির বাণী- ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে। ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে, পয়লা ফাল্গুন আনন্দের দিনে’। আমাদের শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ বসন্তকাল। কবিগুরুর গান ও কবিতায় বসন্ত পেয়েছে বহুমুখী ব্যঞ্জনা। বাংলার পল্লীতে গ্রামে-গঞ্জে সবচেয়ে বেশি মেলা বসে এ ঋতুতে। নানা উৎসব আয়োজন হয়। তাই বসন্ত-বরণে ব্যাকুল হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এবার প্রকৃতিতে এখনও বসন্তের আমেজ আসেনি। শীতের ধকল এখনও আছে। প্রকৃতির এ আবহ কোনো অবস্থাতে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। প্রকৃতির পালাবদলে যে ঐশ্বর্য বিরাজমান, যে চিরায়ত নবরূপে সেজে প্রকৃতি আজ সমৃদ্ধ হবে, সেই চিরন্তন সত্য থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে সুন্দর, প্রাণময় আর নিষ্কলুষ রাখার দীক্ষা নিতে হবে।

লেখক : ভাষা ও সাহিত্য সম্পাদক, জাতীয় লেখক পরিষদ