বসন্তের ডাক

উবাইদুল্লাহ তারানগরী

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ চিরসুন্দর, রূপ-গুণ আর লাল সবুজের দেশ। ছয় ঋতুর দেশ। নাতিশীতোষ্ণ শীত-গরমের ভারসাম্যপূর্ণ এমন দেশ পৃথিবীর কোথাও নেই। বিশ্ব পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঋতুরাজ বসন্তের এ দেশ। আকাশ যেমন নীল রং, তুলার মতো সাদা মেঘের শুভ্রতা, রংধনু, চাঁদ, সূর্য, তারকা, জোছনা ইত্যাদি নিয়ে সজ্জিত তেমনি প্রকৃতি।

এ দেশের ঋতুগুলো নানা রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। রূপ বদলায়, আলো ছড়ায়। দ্যুতি বিকিরণ করে। এসব দেখে চোখ শীতল হয়। হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। বাংলার ঋতু ছয়টি- গ্রীষ্ম, বর্ষা , শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। দুই মাস অন্তর অন্তর এ ঋতুর পরিবর্তন হয়। প্রকৃতিতে উপস্থিত হয় বিচিত্র সুবাস ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এর মধ্যে বসন্ত বছরের শেষ ঋতু। ঋতুর রাজা। পরিবেশবিদদের মতে, বসন্ত সেরা ঋতু। প্রেমিকদের কাছে প্রেম ঋতু। ভাবুকের কাছে রহস্যময়, শিক্ষাগ্রহণের এক দাস্তান, যৌবনের ঋতু। শীত-উত্তর এ ঋতু বসন্ত রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ, স্পর্শ ও সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আসে। প্রকৃতি ও মানব মনে বসন্ত যেভাবে ধরা দেয়, অন্য কোনো ঋতু সেভাবে ধরা দেয় না। বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনেও বসন্তের যে দখল, তা অন্য কারও নেই। গদ্য-পদ্য-নিবন্ধ-প্রবন্ধ-ফিচারের এক বড় অংশ বসন্ত ঘিরে। এ জন্যই বসন্ত ঋতুরাজ। এগুলোও নেয়ামত। আর আল্লাহর নেয়ামত অগণিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা করতে চাও, গুনে শেষ করতে পারবে না।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৪)।

বসন্তের আগমন উপলব্ধির : শীতের রিক্ততা শেষে উষ্ণতা নিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত দুয়ারে দাঁড়িয়ে। ফাল্গুনের প্রথম ভোরের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বসন্তের আগমন। ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস এ বসন্ত থাকে। তবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনে ঋতু-বৈচিত্র্যেও প্রভাব লক্ষণীয়। প্রকৃতি ক্রমেই হারাচ্ছে তার নিজস্ব রূপ। ফাল্গুনের মাঝামাঝি এসেই গ্রীষ্মের দেখা মেলে যায়। তবুও ঋতুর পরিক্রমায় বসন্ত আপন জৌলুস নিয়ে বিরাজ করে আমাদের মাঝে। সাধারণ হৃদয়বান থেকে নিয়ে কবি-সাহিত্যিক সবাই উপলব্ধি করতে পারে বসন্তের আগমন। গাছে গাছে কচি সবুজপাতা। ন্যাড়া বৃক্ষশাখায় বিচিত্র ফুল। ঝিরঝিরে বাতাসে আন্দোলিত উদ্যান, সবুজ ফসল। মুকুলিত আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি গাছ। সুন্দর মধুময় সকাল, শরীর-প্রাণজুড়ানো দখিনা হাওয়া, মৌমাছির গুনগুন শব্দ, এ ফুল থেকে ও ফুলে নাচানাচি। ফুলের সঙ্গে মিতালী। নিষ্পত্র বৃক্ষরাজির হেসে ওঠা নতুন সাজ। ধূসর কুয়াশা কেটে বাগানজুড়ে খেলা করা সোনা রোদ। শিমুল-পলাশের আগুনরূপ। এসব দেখে বোঝা যায় বসন্ত এসেছে। কোকিলের কুহুতান, পাপিয়ার পিউ পিউ ডাক, প্রজাপতির ফুল ভ্রমণ, টুনটুনির তিরিংবিরিং, বসন্ত পাখিদের কিচিরমিচির থেকে বোঝা যায় বসন্তের আগমন ঘটেছে। বসন্তের আগমন মানুষকে সৃজনশীল হতে সহায়তা করে। লেখকরাও পেয়ে যায় সাহিত্যের অনেক উপাদান। উদ্ভিদ জগতে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগে। প্রকৃত ঈমানদার সৃষ্টির অপূর্ব সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়, মুগ্ধ হয়, নত হয়। স্রষ্টাকে খুঁজে পায়। যেদিকে তাকায়, সেদিকেই সৃষ্টির আয়নায় সৌন্দর্যের আড়ালে স্রষ্টার তাজাল্লি দেখতে পায়। ‘শাজার মে, হাজার মে তেরে রঙও বূ হে, যেধার দেখতা হুঁ ম্যাঁয়, ওধার তুহি তু হ্যায়।’ মনের অজান্তেই বলে ওঠে, ‘আমাদের রব! এটি অযথা সৃষ্টি করোনি। হে পবিত্র সত্তা! আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দাও।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯১)।

বসন্তের আগুন রাঙা ফুল : বসন্ত এসে হৃদয়ে এমনভাবে দোলা দেয়, কারও বুঝতে আর বাকি থাকে না। সেজন্যই বলা হয়, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক, আজ বসন্ত’। আসলে বাঙালি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কারণ, আল্লাহতায়ালা আমাদের ঋতুময় এমন একটি সুন্দর দেশ দান করেছেন, যার প্রতি ঋতুতেই কিছু না কিছু ফুল থাকে। স্বতন্ত্র ফুল। ফলে স্ববৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রকৃতি। ফুলগুলো ঋতুজুড়ে আবেশ ছড়িয়ে ঋতুবদলের মধ্য দিয়ে ছুটি নেয়। এরপর শুরু হয় নতুন ফুলের দিন। বসন্ত মানেই ফুলের সমারোহ। চারদিকে চোখ যত দূর যায়, নয়নাভিরাম ফুল আর ফুল। আর ফুল মানেই রঙের মিলনমেলা। গ্রীষ্মকালে আমরা ফলের যে প্রাচুর্য পাই, তার সূচনা এ বসন্তেই। যে ফুলসম্ভার চির শ্যামল বাংলার প্রকৃতিকে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যময় করে তোলে, তা হলো- শিমুল, স্বর্ণশিমুল, পলাশ, অশোক, রজনীকান্ত, রক্তকরবী, আকআড়কাঁটা, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারি, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলীবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মণিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, ক্যামেলিয়া, বেলী ইত্যাদি।

বসন্তের নানান পাখি : বসন্তে মুখরিত থাকে পুরো অঙ্গন পাখিদের কিচিরমিচির ও মিষ্টি সুরে। সব পাখিই বসন্তে সৌন্দর্যের এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে। কোকিল, পাপিয়াসহ আরো বিচিত্র পাখির মধুর কণ্ঠে মুগ্ধ হয় সবাই। সবুজ পাতার ফাঁকে সবুজ পাখির ওড়াউড়িও খুব ভালো লাগে। কোকিলকে বলা হয় বসন্তের পাখি, গানের পাখি। আমাদের দেশে প্রায় ২০ প্রকারের কোকিল বাস করে। ১৪ প্রকার দেশি, ৬ প্রকার পরিযায়ী। কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। পরনির্ভরশীল হলেও মিষ্টি গানের কারণেই মানুষ তাকে ভালোবাসে। বসন্তের শুরুতে অনেক অতিথি পাখি এসেও মুখরিত করে তোলে বিভিন্ন লেক ও হ্রদ। আরও যোগ হয় এর সঙ্গে বাঁশির সুর, কৃষকের গলা ছেড়ে গাওয়া গান। তবে বাঁশি বাজানো ও শিস দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঘণ্টি শয়তানের বাঁশি।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ঢোলক হারাম, বাদ্যযন্ত্র হারাম, তবলা হারাম এবং বাঁশিও হারাম।’ (সুনানে বাইহাকি : ২০৭৮৯)।

বসন্তের আমেজ-উৎসব : বসন্তকালে আবহাওয়া থাকে শীতল। শরীরের সঙ্গে একদম মানানসই। দিনে হালকা গরম, শেষ রাতে শীত শীত ভাব। কাঁথা ছাড়া অনায়াসেই যেখানে সেখানে অবস্থান করা যায়। ফলে খোলা আকাশের নিচেই জমে ওঠে নানা উৎসব। পিঠা উৎসব, বর্ষবরণ উৎসব, হালকা জিকিরসহ বাংলার ঐতিহ্যবাহী রকমারি অনুষ্ঠান। বাহারি রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে ফাগুনের আগুন। সৌন্দর্যের অবতারণা ঘটিয়ে মাতিয়ে রাখতেও দেখা যায় অনেককে।

সাহিত্য সাময়িকীর সাজ : বসন্ত নিয়ে এক সাহিত্যসম্ভার তৈরি হয়েছে। দিন দিন এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সাহিত্য। বসন্ত কবিদের কবিতায়, লেখকের লেখায়, গায়কের গানে, যেভাবে ধরা দেয়, অন্য ঋতু সেভাবে ধরা দেয় না। বাদ পড়ে না সাংবাদিকের ক্যামেরাও। তাই তো দেখা যায়, বসন্তে প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ও ফিচার প্রকাশ। বসন্তময় সৌন্দর্যে রঙিন হয়ে ওঠে সাময়িকীর রঙিন পাতাগুলো। চোখ আটকে যায় কৃষ্ণচূড়া ও সদ্যগজানো শিমুল ফুলের দিকেও। শরতকে অর্থবহ করে যেমন কাশফুল, তেমনি বসন্তকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখে শিমুল-পলাশ ফুল। অনেক পত্রিকা বসন্ত নিয়ে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করে। প্রকৃতির বসন্ত আমাদের মাঝে নিয়ে আসুক আমলী বসন্ত।

লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক