ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভাষা ও সাহিত্য

জাকারিয়া জুবায়ের
ভাষা ও সাহিত্য

বাকযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষ যে মনের ভাব প্রকাশ করে, তাকে ভাষা বলে। এ বাকশক্তি মহান রবের অপার করুণার অনন্য বহিঃপ্রকাশ।

মানব জীবনে আল্লাহতায়ালা থেকে প্রাপ্ত নেয়ামতরাজির মধ্যে ভাষা বা কথন শক্তি এক অমূল্য নেয়ামত। এর শোকরিয়া কেয়ামত পর্যন্ত আদায় করেও শেষ করা সম্ভব নয়। তবে দুনিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে কিঞ্চিত হলেও আদায় হতে পারে, যদি এ বাকশক্তিকে আল্লাহর মর্জি মোতাবেক ব্যবহার করা যায়।

ভাষা আল্লাহর নেয়ামত : ভাষা আল্লাহর এক মহান নেয়ামত। এটা কোনো ভাষার বিশেষের সঙ্গে বিশেষিত নয়; বরং সব ভাষাই আল্লাহর নেয়ামত। আর এ ভাষা ভিন্নতা তো রবের কুদরত বা ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

তাঁর প্রভুত্বের এক অতুজ্জ্বল উদাহরণ। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাঁর (কুদরতের) আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে, মণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃজন। তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।’ (সুরা তহা : ২২)।

ভাষা ও বর্ণ-বৈচিত্রের রহস্য : ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র আল্লাহর অপার করুণার অনন্য বহিঃপ্রকাশ ?ও তাঁর প্রভুত্বের প্রামাণ্য প্রয়াস।

বর্ণ-বৈচিত্র যদি পৃথিবীবাসীর জন্য নিদর্শন হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয় প্রতিটি বর্ণ বা ভাষা আল্লাহর প্রিয় ও মনোনীত। এ দাবির সমর্থন মেলে একটি আয়াত দ্বারা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক পয়গম্বরকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি।

যাতে তারা তাদের পরিষ্কার করে বোঝাতে পারে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন। তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)।

ভাষার সংখ্যা ও স্বীকৃতি : আল্লাহতায়ালা দ্বীন প্রচারের জন্য কোনো ভাষার বিশেষের ব্যুৎপত্তি দিয়ে নবীদের দুনিয়াতে পাঠাননি।

বরং প্রত্যেক ভাষার জ্ঞান দিয়েই প্রেরণ করেছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৭১১১টি।

উইকিপিয়ার তথ্যমতে এ মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য। কেন না, অন্য যতগুলো মত আছে, সেগুলো আগের। যেমন- এসআইএল (সামার ইন্ডাস্ট্রিজ অফ লিঙ্গুইস্টিকস)-এর ২০০৯ সালে চালানো গবেষণা অনুযায়ী, প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯টি। আর ২০১৭ সালে প্রকাশিত ইথনোলোগের বিশতম সংস্করণ অনুযায়ী, বর্তমান পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা ৭০৯৯টি।

মহানবীর সাহিত্যিক বিশেষণ : রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরবের মধ্যে আমি বড় সাহিত্যিক বা সুস্পষ্ট ভাষার অধিকারী।’ (মুজামুল কাবির লিত তাবারানি : ৬/৩৫)। এর দ্বারা বোঝা গেল, প্রত্যেক নবী বলিষ্ঠ ভাষার অধিকারী ছিলেন।

সুতরাং মনোজ্ঞ উপস্থাপন, আবেদনময় প্রকাশ প্রচেষ্টা, সাহিত্য সাধনা ইসলাম বহির্ভুত নয়। বরং ইসলামেরই এক অমূল্য অধ্যায়।

বস্তুত কোনো কথা সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করলে অতটা হৃদয়গ্রাহী হয় না, মনে দাগ কাটে না, যতটা আবেদনপূর্ণ ও প্রক্রিয়াশীল হয় ও মনে দাগ কাটে কথাকে সুবিন্যস্ত ও প্রাণোচ্ছল সাহিত্য ভঙিমায় প্রকাশ করলে।

সাহিত্যপূর্ণ কথা জাদুর মতো মোহিত করে। অন্তরের অন্তগহিনে স্পর্শ করে। এ কারণেই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো কোনো স্পষ্ট বর্ণনা অবশ্যই জাদুসদৃশ।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫০০৪)।

সাহিত্যের অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তা : সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের মূলভিত্তি সমাজ। একটা রাষ্ট্রে যখন নৈতিক অবক্ষয় এবং মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে, তখন গতিশীল যুগোপযোগী সাহিত্য সেই প্রতিকূল আঁধারকে দূরে ঠেলে রচনা করতে পারে একটি স্বর্গীয় উদ্যান।

জাতির মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে জীবন। গড়ে তুলতে পারে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

জাতিকে হতাশা ও চেতনাহীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। আত্মমর্যাদা ও চেতনাবোধ সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য সুস্থ সংস্কৃতি ও ন্যায়নিষ্ঠ সাহিত্যের বিকল্প নেই।

সাহিত্যের প্রয়োজন ও গুরুত্ব ধর্ম-বর্ণ-যুগ-কাল নির্বিশেষে সমানভাবে স্বীকৃত। সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ সব যুগের ও সর্বজনবিদিত। সব যুগেরই মানুষ এর প্রয়োজন উপলব্ধি করেছে। শিক্ষাদীক্ষা, সভ্যতা, ধ্যান-ধারণা ব সাহিত্যের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছে।

এ কারণেই কোনো জাতির শিক্ষা-সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি তাদের জাতীয় মূল্যবোধ ও জীবনঘনিষ্ঠ যে কোনো বিষয়ে জানতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে অবশ্যই সাহিত্যের দ্বারস্থ হতে হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত