রূপসী বাংলার চিরায়ত রূপ
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি বাংলাদেশের প্রকৃতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এই বাংলাদেশ। অপরূপা এ দেশের সবুজ বন-বনানী, নদ-নদী, শ্যামল পাহাড়, বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত। কবি এই বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়ে বাংলাকে রূপসী বাংলা বলেছিলেন। ছয় ঋতুর বৈচিত্র্যময় দেশ এই বাংলাদেশ। যুগ যুগ ধরে কবিরা এই রূপে মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলার উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এশিয়ার ছোট্ট সবুজ ভূমি এই বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-টিলা সবুজ সমতল ভূমি মিলে নানা রকম সৌন্দর্যের বেষ্টন, এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারোহ। বারো মাসের ষড়ঋতুর এ দেশে প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈচিত্র্য নিয়ে আসে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে একসময় বিদায় নেয়।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ, ছাতিমের স্নিগ্ধ ছায়া, নদীর নীলাভ গহ্বর থেকে জেগে ওঠা বালুচর। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠজুড়ে গ্রীষ্মকাল। এ সময় সূর্যের প্রচণ্ড তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভূমি। পানি শুকিয়ে যায়। অনেক নদীই নাব্যতা হারায়। জলশূন্য মাটিতে ধরে ফাটল। গ্রীষ্মকালের শেষার্ধ্বে সন্ধ্যা সমাগত সময়ে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এ সময় গাছে গাছে বিভিন্ন মৌসুমি ফল দেখা যায়। যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এর পরের ঋতু হলো বর্ষাকাল। সে সময় প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত গ্রীষ্মকালীন সব তপ্ততা মিটিয়ে দেয়। গ্রীষ্মে ফোটা ফুল হচ্ছে অর্জুন, ইপিল, কনকচূড়া, করঞ্জা, কামিনী, ক্যাজুপুট, গাব, জারুল, জ্যাকারাণ্ডা, তেলসুর, দেবদারু, নাগকেশর, নাগেশ্বর, নিম, পরশপিপুল, পলকজুঁই, পারুল, পালাম, বনআসরা, বরুণ, বেরিয়া, মিনজিরি, মুচকুন্দ, মেহগনি, রক্তন, সোনালু, স্বর্ণচাঁপা ইত্যাদি। গ্রীষ্ম যতই শুকনো হোক, এ ঋতুতেও ফুলের অভাব নেই।
বর্ষার থই থই জল, অবিরাম বৃষ্টিমেয়ের কান্না আর কদম, কামিনী, কেয়ার স্নিগ্ধ হাসি। বর্ষাই তো বাংলার চিরায়ত রূপ। কখনও রিমঝিম গান গেয়ে বৃষ্টি নামের মিষ্টি মেয়েটি সুরে সুরে ভরিয়ে তোলে প্রকৃতি। আবার ঝুমঝুম নূপুর বাজিয়ে মুগ্ধ করে দেয় আমাদের মন। বর্ষায় খাল-বিল-পুকুর-নদী-ডোবা পানিতে থই থই করে। সবুজ-সজীবতায় গাছপালা, বন-বনানী প্রাণ ফিরে পায়। আর কত ধরনের ফুল ফোটে এ বর্ষায়! খাল-বিলে বাংলার জাতীয় ফুল শাপলার অপরূপ দৃশ্য তো আছেই। কেয়া-কামিনী, হিজল, বকুল, জারুল, করবী ও সোনালু- এসবও বর্ষা ঋতুতে ফুটে থাকতে দেখা যায়। আর জুঁই-চামেলিকে বাদ দেব কী করে! তবে বর্ষার প্রধান ফুল হলো কদম। বৃষ্টিভেজা কদমের মনকাড়া সৌরভ ভিজে বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়ে সারা প্রকৃতিতে।
শরতে সাদা মেঘের ভেলা, কাশফুল দোলানো শান্ত বাতাস, নীল আকাশে উড়ে যাওয়া বলাকার ঝাঁক। শরতের সকাল এক অভূতপূর্ব আনন্দ-অনুভূতির সৃষ্টি করে। শরতের সকালে সূর্য উদিত হয়ে মাঠ ও বিলের অসংখ্য ধানের জমিতে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে দেয়। দূর্বাঘাসের ওপর সঞ্চিত শিশির বিন্দুকে রূপালি মুক্তার বিন্দুর মতো মনে হয়। সকালে শিশিরভেজা ধান, শিউলি ফুল, কোমল রোদের পুকুরে ভাসমান শুভ্র শাপলার হাসি সবার হৃদয়কে উচ্ছ্বসিত করে। মাথার ওপরে নীলাকাশ যেন মাঝেমধ্যে উড়ন্ত সাদা মেঘ। শরৎকালের আরেকটি অসাধারণ আকর্ষণ হলো, অবারিত সবুজ মাঠ। মাঠের পর মাঠ যেন এর শেষ নেই। মাঠের চতুর্দিকে সবুজের প্রাচীরসদৃশ দূরের গ্রাম যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। কৃষকের মধ্যেও আনন্দ এনে দেয় শরৎকাল। বর্ষা চলে গেলে মাঠ থেকে পানি সরে যায়। কৃষক আবার জমি চাষ করতে মাঠে যায়। হেমন্তী ধানের বীজ বোনে, চারা রোপণ করে। বুকে বাঁধে সম্ভাবনার স্বপ্ন। সবুজ ফসলের আনন্দে কৃষকেরও মন ভরে ওঠে। বর্ষার স্রোতস্বিনী শরতেও পূর্ণ থাকে। শরতে নির্মল পানিরাশি সাগরের সঙ্গে মিলনের উদ্দেশ্যে বয়ে যায়। নদীর বুকে মাঝি ভাটিয়ালি গান গেয়ে পালতোলা নৌকা ছাড়ে মনের আনন্দে। দু’কূলে সবুজ বনরাজি যেন সবুজের স্বর্গপুরী। কখনও শরতের নদী কিষানির শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে, কখনও অবারিত সবুজ মাঠের বুক চিরে বয়ে যায় দূর-বহুদূর। নদীর কিনারে বালির চরে হেসে ওঠে কাশবন। শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, শিউলি, জবা, কামিনী, মালতি, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম ফুল, বরই ফুল ও দোলনচাঁপা, বেলি, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, শ্বেতকাঞ্চন, রাধাচূড়া, স্থলপদ্মা, বোগেনভেলিয়াসহ নানা রকমের কত ফুলে হেসে ওঠে গ্রামবাংলার রূপ!
হেমন্তে পাকে ধান। আসে নবান্নের উৎসব। ঘাসের ওপর জমে ওঠে ছোট ছোট শিশির বিন্দু। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে হেমন্তের ব্যাপ্তিকাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। হেমন্ত শরতেরই বিলম্বিত রূপ। হেমন্তে শরতের মতো নেই কোনো প্রাচুর্য। আছে সুদূর ব্যাপ্ত এক বৈরাগ্যের বিষণ্ণতা। রূপসী হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলানোর নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেত-খামারে ভরপুর সোনার ধান ঘরে তোলা হয়। চারিদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা, ঘরে ঘরে চলে নবান্নের উৎসব। প্রাচুর্যময়ী হেমন্তের সৌন্দর্যের জৌলুশ কম। রূপসজ্জার নেই তেমন প্রাচুর্য, আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সোনার ধানে ভরিয়ে দিয়ে শিশিরের মতো নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।
শীত আসে কুয়াশার চাদর পরে। অসংখ্য শিশির কণায় ঝলমল করে ওঠে বাংলার মুখ। সকালের মিষ্টি রোদে ভরিয়ে দেয় উঠান। উত্তরি বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে শিরশির করে গাছের পাতারা। সুন্দর টুপটাপ শিশির পড়ার শব্দ। শিশির সিক্ত গ্রামের মেঠোপথ। শীতের সকালে প্রকৃতির এক অপূর্ব নীরবতা আর শুভ্রতার মাখামাখি। দূরের গ্রামগুলো দেখা যায় না। শীতের ভোরের শুভ্রতা, ধীরে ধীরে লাল সূর্য ওঠা, মিষ্টি রোদে উঠান ভরে যায়। কচি সবজি গাছের শিশির ভেজা সবুজ চারা আর তাদের বেড়ে ওঠা কতই না মধুর আর সুন্দর! হলুদ সর্ষের ফুল আর নুইয়ে পড়া মটরশুঁটির পা জড়িয়ে ধরা। এই সুন্দর সজীবতা আর মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সখ্যতা শুধু বাংলাদেশেই লক্ষ্য করা যায়। বসন্তের দক্ষিণা হাওয়ার শীতল পরশে শান্তির ছোঁয়া পাই। প্রকৃতি সেজে ওঠে সবুজ সজীবতায়। গাছে গাছে কোকিলের কুহুতান। ডালে ডালে ফুল ফোটে। অলিরা জোটে। ভ্রমরের গুঞ্জন শোনা যায়। শীতের কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে আবির্ভাব হয় বসন্তের। সবুজ কিশলয়ে ভরে ওঠে চারিদিক। দক্ষিণের মিষ্টি হাওয়া আনমনে বয়ে যায় সবুজ ধানখেতে। সবুজ ধানের চারা আনন্দে আন্দোলিত হয়। নীলাকাশে বলাকার ঝাঁক উড়ে যায়। ফুলে ওঠে নৌকার পাল। বৃক্ষের বাকল চিরে বেরিয়ে আসে নতুন পাতা। প্রকৃতি যেন অপেক্ষায় ছিল এই বসন্ত ঋতুর জন্য।
বিরাট এক শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা এই সৌন্দর্য লিখে বা বলে ঠিক বর্ণনা করা যায় না। সবুজ শ্যামল বাংলার প্রকৃতিজুড়ে ছয় ঋতুর অপরূপ খেলা চলে সারাটি বছর ধরে। প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের রূপ ছড়িয়ে আছে গোটা দেশজুড়ে। শাল, মহুয়ার ঘন বীথি, ঝিলিমিলি ঝিল আর বিশাল বিল প্রকৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যশালী ও লাবণ্যময়ী। ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, সবুজ শ্যামল প্রকৃতিময় আছে সুখশান্তি-সমৃদ্ধির অফুরন্ত ভান্ডার। তবে এই সোনার বাংলার সৌন্দর্য রক্ষা করতে হলে আমাদের আগে নৈতিক আদর্শে মনকে সাজাতে হবে। নইলে আমাদের অনৈতিক চলনে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই নিজে সুন্দর হই এবং দেশকে সুন্দর রাখি।