ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাহে রমজানে খেজুরের বাহারি গল্প জান্নাতুল মাওয়া

মাহে রমজানে খেজুরের বাহারি গল্প জান্নাতুল মাওয়া

বিশ্বের সবচেয়ে পুষ্টিকর ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম খেজুর। একে সুপার ফুডও বলা হয়। দৈনিক মাত্র ১৫টি খেজুর খেয়েই একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর পবিত্র ফল হিসেবে বিবেচিত। আবার একটি খেজুর গাছকে জীবনের গাছও বলা হয়।

খেজুর কী : খেজুর শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘ডাক্টাইলস’ থেকে। যার অর্থ আঙুল। একটি খেজুর দেখতেও ঠিক আঙুলের ডগার মতোই। পুষ্টিকর এ ফলের বয়স প্রায় ৮ হাজার বছরেরও বেশি। প্রাচীন মিশরীয়রা খেজুরের ওয়াইন তৈরি করতে ফল ব্যবহার করত। ফসল কাটার সময় তা খেত। সর্বপ্রথম ইরাকে খেজুর উৎপন্ন হয় বলে জানা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন চাষ করা গাছ খেজুর। এটি উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ৫ হাজার বছর ধরে চাষ করা হচ্ছে।

খেজুরের জন্ম : খেজুর পাম পরিবারের গাছ। এক বীজযুক্ত এ ফলের গাছ মরুভূমি অঞ্চলে বেশি জন্মে। খেজুর গাছ সাধারণত ২১ থেকে ২৩ মিটার (৬৯ থেকে ৭৫ ফুট) উচ্চতায় পৌঁছে। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সেচযোগ্য মরুভূমিতে ব্যাপক আকারে খেজুর চাষ হয়। সেখানকার খাদ্য ও সম্পদের প্রধান উৎস খেজুর। ১৯ শতকের প্রথম দিকে স্প্যানিশ মিশনারিরা খেজুর গাছকে বিশ্বে নতুনভাবে পরিচয় ঘটায়। একে একে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, ভারত, মেক্সিকো ও ক্যালিফোর্নিয়ায় বৃহৎ আকারে খেজুর উৎপাদন শুরু হয়।

খেজুরের বেড়ে ওঠা : একটি খেজুর গাছে ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ফল ধরতে শুরু করে। ১০ থেকে ১৫ বছরে পূর্ণ ফল দেয় গাছটি। প্রতিবার ফলনে ৪০ থেকে ৮০ কেজি (৯০ থেকে ১৮০ পাউন্ড) বা তার বেশি খেজুর হয়। খেজুর গাছের সর্বোত্তম মানের ফল উৎপাদনের জন্য কমপক্ষে ১০০ দিন ১০০ ডিগ্রি ফারনহাইট তাপ ও প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। একটি খেজুর গাছ দেড়শত বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। যদিও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গাছটিতে ফল উৎপাদন কমে যায়।

খেজুর উৎপাদনে এগিয়ে : বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বর্তমানে খেজুর উৎপাদন হয়। যার মধ্যে মিশর, ইরান, সৌদি আরব ও ইরাক শীর্ষস্থানীয় খেজুর উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশ। যদিও আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার খেজুরও ইউরোপে সুপরিচিত। আমেরিকার ক্যালিফোনিয়াতেও খেজুর উৎপাদিত হয়। প্রতি বছর মিশরে উৎপাদিত হয় প্রায় ১৬ লাখ মেট্রিক টন খেজুর। সে হিসেবে শীর্ষ খেজুর উৎপাদনকারী দেশ মিশর। অন্যদিকে ১৫ লাখ মেট্রিক টন খেজুর উৎপাদন করে দ্বিতীয় সৌদি আরব। তিন, চার ও পাঁচে আছে ইরান, আলজেরিয়া ও ইরাক। যথাক্রমে উৎপাদন করে ১৩ লাখ, ১১ লাখ ও সোয়া ৬ লাখ মেট্রিক টন। পৃথিবীর প্রায় ৩ শতাংশ কৃষি জমি খেজুর গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত। বছরে ৪ মিলিয়ন টন খেজুর উৎপাদিত হয় বিশ্বে।

খেজুরের প্রকারভেদ : সারা বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির খেজুর আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রায় ৪৪ মিলিয়ন খেজুর গাছে ১৯৯ টিরও বেশি প্রজাতির খেজুর উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে আজওয়া, অ্যাম্বারা, আমেরি, বারহি, দাইরি, ড্যাগলেট নুর, শুকনো খেজুর, হালাউই, ইতিমা, কালমি, খাদরাওয়ে, খোলা, খুদরি, মাবরুম, মাজাফতি, মাকতুম, মেডজুল, মিগরাফ, সাঘাই, সাফাভি, সাইদি, সেমি সফট, সফট, সুক্কারি, থুরি, ওয়ার হাউজ, ওমানি ও জাহিদি খেজুর অন্যতম।

বিশ্বের জনপ্রিয় খেজুর : বিশ্বের জনপ্রিয় খেজুরের মধ্যে মেডজুল অন্যতম। এটি সৌদি আরব, জর্ডান ও মরক্কোতে চাষ করা হয়। এটি খেজুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতের একটি। লালচে-বাদামি রঙের এ খেজুর স্বাদে খুবই সুস্বাদু। একইভাবে ওমানি খেজুরও খুবই জনপ্রিয় বিশ্বে। এটি ওমান ও মধ্যপ্রাচ্যে উৎপাদিত হয়। গাঢ় বাদামিরঙা এ খেজুর আকারে বড় ও রসালো হয়। ড্যাগলেট নুর নামক খেজুরটি আবার গাঢ় সোনালি ও বাদামিরঙা হয়। আলজেরিয়ার টলগা, বিস্করা ও ওউদ রাইয়ে এ খেজুর উৎপাদিত হয়। অনেকটা গোলাকার ও মাঝারি আকারের হয় এ খেজুরগুলো। খুব নরম ও স্বাদে মিষ্টি এ খেজুর। মাঝারি মিষ্টি খেজুর হলো, আমেরি। এটিও গোলাকৃতির খেজুর। ইরাকেই বেশি উৎপাদিত হয় এ খেজুর। হালকা বাদামিরঙা সুস্বাদু আরেকটি খেজুরের জাত হলো, জাহিদি। এর উৎপত্তি উত্তর ইরাকে। এর স্বাদ চিনাবাদামের মাখনের মতো। এগুলো ডিম্বাকৃতি ও মাঝারি মাপের হয়। হালাউই খেজুর বেশ সূক্ষ¥। এর উৎপত্তি মেসোপটেমিয়ায়। ক্যারামেল ও মধুর মতো স্বাদ এ খেজুরের। অন্যান্য খেজুর জাতের তুলনায় এটি আকারে ছোট। ইরানের কেরমান থেকে উদ্ভুত মাজাফতি খেজুরের স্বাদ আবার ক্যারামেল ও চকলেটের মিশ্রণের মতো। গাঢ় বাদামিরঙা এ খেজুরের গায়ে মাংস বেশি। এর আকার ২.৫-৪ সেন্টিমিটার। মিষ্টি ও গাঢ় কালোরঙা আরেক খেজুরের জাত হলো, সাফাভি। সৌদি আরবে এর উৎপত্তিস্থল। মাঝারি আকারের এ খেজুর গোলাকার হয়।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেজুর : বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেজুর হলো আজওয়া। হাদিসে আজওয়া খেজুরের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, বিষ ও জাদু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (মুসলিম : ২০৪৭)। আজওয়ার মধ্যেও আবার অনেক পদ আছে। সৌদি আরব থেকে আসে এ আজওয়া খেজুর। এর দাম প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। মদিনায় এ খেজুরের ফলন হয় বেশি। আজওয়া খেজুর কালো ও মাঝারি আকৃতির হয়। পুষ্টি ও মানের দিক দিয়ে সবচেয়ে ভালো খেজুরগুলোর মধ্যে আজওয়া রয়েছে প্রথম সারিতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে মেডজুল খেজুর। একে আবার খেজুরের রাজা বলা হয়। কেজি প্রতি এর দাম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। বাংলাদেশের বাজারে ১০০টিরও বেশি প্রজাতির খেজুর পাওয়া যায়। যার মধ্যে মাবরুম, মরিয়ম, সুকারি, সুগাই, ভিআইপি, মাশরুক, কালমি, আম্বার ও আজওয়া অন্যতম।

ভালো খেজুর চেনার উপায় : রমজানে মিশর, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, দুবাই, তিউনিসিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও আলজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে খেজুর আসে বাংলাদেশে। এ মাসে খেজুরের চাহিদা বেশি থাকায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বিক্রি করেন। তাই খেজুর কেনার আগে তাতে কৃত্রিম মিষ্টি বা অন্য কোনো উপাদান মেশানো আছে কি না, নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। ভালো মানের খেজুর চেনার বেশ কিছু উপায় রয়েছে। যেমন- সতেজ ও তাজা খেজুরের চামড়া সাধারণত কুঁচকানো হয়; তবে শক্ত হবে না। আবার ওপরের চামড়াও বেশি নরম হবে না; কিন্তু চকচকে ও উজ্জ্বল থাকবে। খেজুরের গায়ে চিনি বা দানাদার কিছুর উপস্থিতি থাকবে না। যদি খেজুরের গায়ে তেল বা পাউডার জাতীয় কিছুর উপস্থিতি থাকে, তাহলে তা ভেজাল, মানহীন কিংবা নিম্নমানের খেজুর। ভালো খেজুর চেনার আরো একটি কৌশল হলো, পিঁপড়া ও মাছির উপস্থিতি লক্ষ্য করা। যদি খেজুরের সামনে মাছি ও পিঁপড়া ভিড় করে, তার মানে সেটি ভালো খেজুর না। প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান যে মিষ্টি খেজুরে থাকে, তা কোনোক্রমেই পিঁপড়াদের আকৃষ্ট করবে না, যদি না তাতে কৃত্রিম চিনি বা মিষ্টি মেশানো হয়। প্যাকিং করা খেজুর কেনাই সবচেয়ে ভালো। এ খেজুরগুলোর প্যাকেটে সাধারণত মেয়াদ লেখা থাকে। এছাড়া খোলা খেজুর কিনতে হলে খেয়াল রাখতে হবে, খেজুরে যেন পচা গন্ধ, পোকা ধরা, বেশি কালচে বা শুকিয়ে যাওয়া না হয়। খেজুর সাধারণত দেড় বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে ফ্রিজের নরমালে রাখলে খেজুর সবচেয়ে বেশি ভালো থাকে।

খেজুরের পুষ্টিগুণ : ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) খেজুরে থাকে ২৪২ ক্যালোরি। এ খাবারে ক্যালোরির একটি বড় অংশ শর্করা থেকে আসে। খেজুর অ্যানার্জি, ফাইবার, চিনি, বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের ভালো উৎস। এছাড়া ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার ও জিঙ্কের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ খেজুরে পাওয়া যায়। এছাড়া এ ফলে থাকে থিয়ামিন, রিবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি ৬, ফোলেট, ভিটামিন এ ও ভিটামিন কে। খেজুরের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতার মধ্যে আছে হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা, হৃদরোগের উন্নতি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উন্নতি, ত্বকের জন্য উপকারী, প্রদাহ প্রতিরোধ, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া সারাতেও সাহায্য করে খেজুরে থাকা গুণাগুণ। শুকনো খেজুরে আবার চিনির পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। যা ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়াতে পারে। যারা ওজন কমানোর কথা ভাবেন, তাদেরও খেজুর এড়িয়ে চলা উচিত।

খেজুর নিয়ে মজার তথ্য : ১. একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন মাত্র ১৫টি খেজুর খেয়েই বেঁচে থাকতে পারেন। কারণ, এ ফলে সব ধরনের পুষ্টিগুণই মেলে। যা শরীরের বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ ও মিনারেলের চাহিদা মেটায়।

২. খেজুর সাবান এমনকি আইলাইনার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।

৩. খুব কম মানুষেরই এ ফলে অ্যালার্জি আছে।

৪. খেজুর সৌদি আরবের জাতীয় প্রতীক।

৫. খেজুর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে অনেকবার বলা হয়েছে।

৬. খেজুর খুব লবণ সহনশীল গাছ। ক্ষারীয় মাটিতে ভালো জন্মে এ গাছ।

৭. ওমানে যখন একটি ছেলের জন্ম হয়, তখন তারা একটি খেজুর গাছ লাগায়। খেজুর গাছটি তার সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়। এমনকি ধারণা করা হয়, তার পরিবার কখনও ক্ষুধার্ত হবে না।

৮. মধ্যপ্রাচ্যের বেদুইন উপজাতিরা খাদ্য তালিকায় বেশি পরিমাণে খেজুর রাখেন। দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ক্যান্সারের হার সবচেয়ে কম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত