গাছ-গাছালি প্রকৃতির প্রকৃত সৌন্দর্য। গাছে গাছে যখন খেজুর ঝুলে, সে দৃশ্য কতই না সুন্দর! খেজুর দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমন সুস্বাদু। খেজুর যখন আমরা খাব, তখন নেয়ামত মনে করে খাব। তাহলে আল্লাহ এ নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি তোমাদের জন্য তা বৃদ্ধি করে দেব।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)।
খেজুর গাছের সঙ্গে উপমা : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘গাছগাছালির মধ্যে এমন একটি গাছ আছে, যার পাতা ঝরে পড়ে না এবং তা হলো মোমিনদের উপমা। তোমরা জানো, সেটা কোন গাছ?’ সাহাবিদের খেয়াল জঙ্গলের গাছগাছালির প্রতি ধাবিত হলো। আবদুল্লাহ (রা.) বললেন, ‘আমার মনে হলো, তা খেজুর গাছ; কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে আমি সংকোচ বোধ করলাম।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনিই আমাদের গাছটির নাম বলে দিন।’ তখন তিনি বললেন, ‘গাছটি হলো, খেজুর গাছ।’ আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘তারপর আমি আমার বাবাকে আমার মনে যে খেয়াল এসেছিল, তা বললাম।’ তিনি বললেন, ‘তুমি যদি তখন তা প্রকাশ করতে যে, তা হলো খেজুর গাছ, তাহলে আমি অমুক অমুক বস্তু লাভ করার তুলনায় অধিক খুশি হতাম।’ (মুসলিম : ২৯৯৯)।
খেজুর একটি সুন্নতি খাবার : খেজুর সর্বোত্তম খাবার। খেজুর যেমন সুস্বাদু ফল, তেমনই একটি প্রিয় ফল। রাসুল (সা.) খেজুর খেয়েছেন। হাদিসে খেজুর খাওয়ার কথা রয়েছে। তাই খেজুরের প্রতি আমাদের ভালো লাগা রয়েছে। রমজানে আমরা খেজুর দিয়ে ইফতার করি। বরকত লাভের আশায় আমরা ইফতারিতে খেজুর আবশ্যকীয়ভাবে রাখি। সারা দিন রোজা রাখার পর একটি খেজুর দিয়ে ইফতারি করতে পেরে আনন্দে ভরে ওঠে মন। সুন্নত আদায়ের জন্যও আমরা খেজুরকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার কাছে খেজুর আছে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৫৫)।
খেজুর বরকতময় একটি ফল : জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা বরকত চাই। ইফতারেও আমরা বরকত চাই। আর সেই বরকতের জন্য খেজুরের তুলনা হয় না। কারণ, খেজুর একটি বরকতময় ফল। ইফতারিতে খেজুর রেখে আমরা বরকত লাভে ধন্য হতে পারি। সালমান ইবনে আমের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে, সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তাতে বরকত ও কল্যাণ রয়েছে।’ (মেশকাত : ১৮৯৩)।
খেজুর খুবই উপকারী ফল : আমাদের প্রবণতা হলো, আমরা সবকিছুর উপকারিতা জানতে চাই; তারপর সেটা গ্রহণ করি। উপকারী জিনিস সবাই লুফে নিতে চাই। খেজুর শুধু সুন্নতি খাবার নয়, বরং অনেক উপকারী একটি ফল। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, বিষ ও জাদু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (মুসলিম : ২০৪৭)।
খেজুর পুষ্টিকর ফল : সাধারণত আমরা সুস্বাস্থ্য লাভের জন্য সর্বদা পুষ্টিকর খাদ্য খেতে পছন্দ করি। পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে চাই। খেজুর একটি পুষ্টিকর ফল। খেজুরে রয়েছে ভিটামিন, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্ক। যা সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। খেজুর খেয়ে মানুষ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। অসুস্থ হলেও খেজুর খাওয়া সুন্নত। কেউ অসুস্থ হলে রাসুল (সা.) তাকে খেজুর খাওয়ার নির্দেশ দিতেন। সাইদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসুল (সা.) আমাকে দেখতে এলেন। রাসুল (সা.)-এর পবিত্র হাতের শীতলতা আমার অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেল। অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি অন্তরে কষ্ট অনুভব করছ। তুমি হারেস ইবনে কালদা সাকিফির কাছে যাও। কারণ, সে একজন চিকিৎসক। সে যেন মদিনার সাতটি আজওয়া খেজুর নিয়ে বীজসহ পিষে তোমার মুখে ঢেলে দেয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৮৭৫)।
বাসায় খেজুর রাখা : প্রয়োজনে কিংবা শখে আমরা বাসায় খাবারের জন্য নানা ধরনের ফল রাখি। দুঃখজনক হলেও সত্য, রমজান মাস ছাড়া বাসায় খেজুর রাখি না। খেজুরকে রমজানের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছি। অর্থাৎ রমজান এলে খেজুর খেতে হবে, অন্য সময় খেজুর খেলে সওয়াব পাওয়া যাবে না; এমন ধারণা করি। অথচ হাদিসে সবসময় বাসায় খেজুর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ঘরে খেজুর নেই, সে বাড়িতে কোনো খাবার নেই।’ (মুসলিম : ২০৪৬)।
মেহমানদারিতে খেজুর পরিবেশন : বাড়িতে মেহমান এলে আমরা তার জন্য কত কিছু না করে থাকি। তার আতিথেয়তায় যেন কোনো কমতি না হয়, সেজন্য চেষ্টা করি। রকমারি খাবার পরিবেশন করি। বিভিন্ন ধরনের ফল দিয়ে আপ্যায়ন করি। অনেক পদের খাবার রান্না করি। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুল (সা.)-কে খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এক রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। বাইরে এসে আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-কে দেখতে পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ সময় তোমরা কেন বেরিয়েছে?’ তারা উত্তর দিলেন, ‘ক্ষুধার কারণে।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা যে কারণে বেরিয়েছ, আমিও সে কারণে বেরিয়েছি। চলো।’ তারা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সঙ্গে চললেন। রাসুল (সা.) তাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক আনসারি সাহাবির বাসায় পৌঁছুলেন। সেই সাহাবি রাসুল (সা.)-কে দেখে বললেন, ‘আলহামদুলিলাহ, আজ আপনাদের চেয়ে উত্তম মেহমান আর কেউ হবে না।’ তিনি ভেতরে চলে গেলেন। ভেতর থেকে তাদের জন্য খেজুর নিয়ে এসে বললেন, ‘আপনারা খেজুর খেয়ে নিন।’ (মুসলিম : ২০৩৮)।
যে সময়ে খেজুর খাওয়া উত্তম : ১. সাহরিতে : আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাহরিতে খেজুর খাওয়া কতই না উত্তম।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৪৫)। ২. ইফতারিতে : আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) খেজুর দিয়ে ইফতারি করতেন। (মুসনাদে আহমদ : ১২৬৭৬)। ৩. ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে : আনাস ((রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন খেজুর না খেয়ে নামাজে বের হতেন না।’ (বোখারি : ৯৫৩)।