পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ
মিনহাজুল আরিফীন
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কোরআন-সুন্নাহে ঈমানের অনেক শাখা-প্রশাখার কথা এসেছে। ঈমানের পূর্ণতার জন্য সেগুলো নিজের মাঝে ধারণ করতে হবে। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়াও ঈমানের একটি শাখা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরোর্ধ্ব কিংবা ষাটোর্ধ্ব শাখা রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাখা হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা আর সবচেয়ে সাধারণ শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া।’ (বোখারি : ৯, মুসলিম : ৩৫)। অর্থাৎ ঈমানের ন্যূনতম দাবি, চলার পথে সাধ্যানুযায়ী কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া। এটি আমাদের নাজাতেরও কারণ হয়ে যেতে পারে! পথের কষ্ট বিভিন্নভাবে হতে পারে। চলার পথে কোনো গর্তে পড়ে পা মচকে যেতে পারে। পড়ে থাকা কোনো কাঁটা বা ভাঙা কাঁচের টুকরো কারও পায়ে বিঁধে যেতে পারে। ইটের টুকরা বা শক্ত কোনো কিছুতে কেউ হোঁচটও খেতে পারে। পড়ে থাকা কোনো ফলের খোসা কিংবা পলিথিনে কারও পা পিছলে যেতে পারে। ময়লা-আবর্জনা বা দুর্গন্ধযুক্ত কোনো কিছু পথিকের কষ্টের কারণ হতে পারে। এমনকি দৃষ্টিকটু কোনো বিষয়ও অন্যদের কষ্ট ও বিরক্তির কারণ হতে পারে। তাই ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘কষ্ট দ্বারা উদ্দেশ্য, পাথর, মাটির টুকরো, কাঁটাসহ কষ্টদায়ক সবকিছু।’ (শরহু মুসলিম লিন নববি : ২/৬)। তা ছাড়া এটি আপেক্ষিক বিষয়ও বটে। কারও জন্য কষ্টের, আবার কারও জন্য কষ্টের না-ও হতে পারে। কষ্টের ধরন একসময় হতে পারে স্বাভাবিক সহনীয়, আরেক সময় অস্বাভাবিক-অসহনীয়। কোনোটা দেখতে দৃষ্টিকটু হওয়ার কারণে কষ্টদায়ক, কোনোটা চলতে গেলে কষ্টের কারণ হয়। আবার কোনোটা বড়দের কষ্ট না হলেও ছোটদের জন্য কষ্টকর। রাস্তায় এক টুকরো টিস্যু পেপার পড়ে থাকতে দেখে কারও জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, আবার কারও গোবর দেখেও কোনো সমস্যা না হতে পারে। কাজেই আমাদের সরিয়ে ফেলতে হবে সবকিছু; যাতে কোনো ধরনের দৃষ্টিকটু জিনিস চোখে না পড়ে। আসলে ইসলামের শিক্ষা মেনে চললে সবরকম কষ্টদায়ক বস্তু থেকেই পথঘাট মুক্ত থাকবে।
কষ্টদায়ক জিনিস অপসারণ করা সদকা : অন্যকে দান করে কমবেশি আমরা সদকার সওয়াব লাভ করি। যদিও সেটি সদকার প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিন্তু এর বাইরেও সদকার সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু পথ রাসুল (সা.) আমাদের বাতলে দিয়েছেন। একটি হলো, পথের কষ্ট দূর করা। সদকার মাধ্যমে যেভাবে সদকাণ্ডগ্রহীতার প্রতি উপকার ও কল্যাণ পৌঁছে দেয়া হয়, পথের কষ্ট দূর করা ও পথচারীর নিরাপদ পথচলা সহজ করার মাধ্যমেও আমাদের পক্ষ থেকে পথচারীর প্রতি এক ধরনের কল্যাণ পৌঁছানো হয়। তাই রাসুল (সা.) বলেন, ‘পথের কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেয়া সদকা।’ (মুসলিম : ১০০৯)।
অন্য এক হাদিসে নবীজি (সা.) পথের কষ্টদায়ক কিছু বস্তুর নাম ধরে ধরেও বলেছেন, পথ থেকে এগুলো সরিয়ে দেয়া সদকা। যেমন- রাসুল (সা.) আবু জর গিফারি (রা.)-কে বেশকিছু উপদেশ দেন। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল, ‘রাস্তা থেকে পাথর, কাঁটা, হাড্ডি সরানোও তোমার জন্যএকটি সদকা।’ (তিরমিজি : ১৯৫৬)।
ক্ষমাপ্রাপ্তির অন্যতম আমল : বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তায় চলতে চলতে একটি কাঁটার ডাল পেল, সে সেটিকে সরিয়ে দিল। আল্লাহ তার এ কাজের কদর করলেন এবং তাকে পাপমুক্ত করে দিলেন।’ (মুসলিম : ৫০৪৯)। অর্থাৎ তেমন বিরাট কোনো আমলের কারণে নয়, বরং মানুষের যাতায়াতের রাস্তায় একটি কাঁটাদার গাছ ছিল, এ ব্যক্তি সেটি কেটে দিয়েছিল। যাতে পথিকের পথচলা নির্বিঘ্নে হয়। এ আমলের বরকতেই আল্লাহ তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিয়েছেন। রাস্তায় চলাচলের সময় অনেক কষ্টদায়ক বস্তু আমাদের নজরে আসে। কিন্তু আমরা মনে করি, এটা তো সরকারের কাজ, তারা করবে। তাদের করা উচিত, কিন্তু আমরা মুসলমান, সুতরাং এটা আমাদেরও দায়িত্ব। কারণ, এটা আমাদের ঈমানের দাবি। শুধু তাই নয়, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরানো পাপমুক্তির মাধ্যম। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় রাস্তায় কাঁটাদার গাছের একটি ডাল পেল। তখন সেটাকে রাস্তা হতে অপসারণ করলে আল্লাহ তার এ কাজকে কবুল করে নিলেন। ফলে তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ (বোখারি : ৬৫২)। এ হাদিসের আলোকে বলা যায়, মোমিনের কাছে ঈমানের ন্যূনতম দাবি হলো, সে যখন রাস্তায় চলবে, কষ্টদায়ক কিছু দেখলে সরিয়ে দেবে। হতে পারে, এ উসিলায় সে কেয়ামতের দিন নাজাত পেয়ে যাবে।
রাস্তা নোংরা করার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি : নবীজি (সা.) তার প্রিয় সাহাবিদের পথের কষ্ট দূর করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কারণ, নিরাপদ পথের প্রয়োজনীয়তা আমাদের সমাজবদ্ধ জীবনে সবার জন্যই অনস্বীকার্য। এর জন্য নবীজি (সা.) যেমন উৎসাহিত করেছেন, অবহেলার জন্য ভীতিও প্রদর্শন করেছেন। মোমিন তো সে, যার কারণে অন্য কেউ কষ্ট পায় না। মোমিন তো সে, যে অন্যের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করে। অন্যকে আরাম পৌঁছানোর চিন্তা করে। এমনকি আরেক ভাই যেন কষ্টের শিকার না হন, তার জন্য সে নিজেও কষ্ট করতে প্রস্তুত থাকে। এটি মোমিনের আখলাক এবং ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক সময় আমাদের থেকেও এমন কাজ হয়ে যায়, যা কখনও মোমিনের জন্য শোভনীয় নয়। এ ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) ঘৃণিত একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এবং তাকে অভিশাপের কারণ বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুই অভিশাপকারী থেকে তোমরা সতর্ক থাক।’ সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! দুই অভিশাপকারী কী?’ তিনি বললেন, ‘যে মানুষের চলাচলের রাস্তায় অথবা তাদের ছায়া গ্রহণের স্থানে পেশাব-পায়খানা করে।’ (মুসলিম : ২৬৯, সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৪১৫)।