ঢাকা ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইউক্রেনে যেভাবে কাটে মাহে রমজান

মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। বিশ্বে নানা কারণে এখন আলোচিত দেশ ইউক্রেন। সেখানকার মুসলিমরা এবারের রমজান কীভাবে পালন করছেন, বিবিসি, আরব নিউজ ও রয়টার্সের সূত্রে জানাচ্ছেন- মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ইউক্রেনে যেভাবে কাটে মাহে রমজান

রমজান পরিকল্পনা ভেস্তে : ইউক্রেনের জনগণের ক্ষুদ্র একটি অংশ মুসলিম। বেসরকারি হিসেবে অনুমান করা হয়, মুসলিমদের সংখ্যা হয়তো ১ শতাংশের কাছাকাছি। গত দুটি রমজানে তারা কোভিড মহামারির কারণে সেভাবে কোনো উৎসব পালন করতে পারেনি। তাই এবার খুব আগ্রহ নিয়ে রমজানের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।

যুদ্ধাঞ্চলে বিষাদী রমজান : ‘আপনি যখন সারাক্ষণ কেবল সাইরেনের আওয়াজই শুনছেন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্কুল, হাসপাতাল এবং বাড়ির ছবি দেখছেন, তখন কীভাবে স্বাভাবিক থাকবেন?’ প্রশ্ন ছুড়ছেন নিয়ারা মামুতোভা। ‘লাশ এবং পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখে আমি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে যাই। এবারের রমজানে আমাদের এমন কষ্ট’- বললেন নিয়ারা। তিনি একজন জাতিগত তাতার। ২০১৪ সালে যখন রাশিয়া ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়। তখন সেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন।

রমজানের পবিত্র আবহ নেই : নিয়ারার মতো একই কথা বললেন আরেক ইউক্রেনিয়ান নারী কিয়েভের বাসিন্দা ভিক্টোরিয়া নেসটারেংকো। এ দুই নারী জানিয়েছেন কীভাবে একটি যুদ্ধাঞ্চলের মধ্যে তারা এবারের রমজান কাটাচ্ছেন! মন বিষাদে ভরা উল্লেখ করে ভিক্টোরিয়া বলেন, ‘যুদ্ধের ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য সারাক্ষণ আমার মাথার মধ্যে ঘুরছে। কিয়েভের কাছে রুশ সৈন্যদের হাতে শিশুসহ অনেক বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। এবারের রমজানে ওই পবিত্র আবহটা অনুভব করতে পারছি না। আমার মন খুব বিষাদগ্রস্ত।’

মানসিক চাপ আর অবসাদ : ‘সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে, নিজেকে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করা। আমাদের আরও বেশি করে কোরআন পাঠ করা দরকার, আরো বেশি সময় ধরে নামাজ পড়া দরকার। কিন্তু এখন ইবাদতে মন দেওয়া খুব কঠিন। কারণ, আমরা মানসিক চাপ আর অবসাদের মধ্যে আছি’- বলছেন ভিক্টোরিয়া।

ধর্মীয় ফরজ অন্তত রক্ষা : ভিক্টোরিয়া বলেন, ‘আমরা নামাজ পড়ার জন্য হয়তো সময় ঠিকই বের করে নিচ্ছি। যুদ্ধের কারণে এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য কিছুটা মাফ আছে। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যদি পড়তে না পারি, সেটা হয়তো পরে কাজা করা যায়- দিনেরটা সন্ধ্যায় বা সন্ধ্যারটা রাতে আদায় করতে পারি। এভাবে আমরা আমাদের ধর্মীয় ফরজ অন্তত রক্ষা করতে পারি।’

কোথাও নিরাপদ নয় : কোথাও নিরাপদ নয়- উল্লেখ করে নিয়ারা জানান, গত আট বছর ধরে তিনি ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় যাপোরিঝিয়া শহরে থাকেন। সেখানে তিনি একটি এনজিও চালান। যেটি পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো বা মুসলিমদের ব্যাপারে গৎবাঁধা ভুল ধারণা দূর করতে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। তার চতুর্থ সন্তানের জন্ম হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

তেলের গুদামে আগুন : নিয়ারা এবং তার পরিবার তখন রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে বাড়িঘর পরিষ্কার করে সাজানোর কথা ভাবছিলেন। তখন তারা একটা বিরাট ধাক্কা খেলেন। বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ছিল। তেলের গুদামে আগুন জ্বলছিল। রুশ সেনারা শহরের খুব কাছে চলে আসছিল। তখন তারা সেখান থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

চারদিকে রক্তের স্রোত : রাশিয়া যখন ক্রাইমিয়া দখল করে নিয়েছিল, তখন সেটা প্রায় রক্তপাতহীনভাবেই করতে পেরেছিল। কিন্তু এবারের অভিযান একেবারে নির্মম। চারদিকে রক্তের ¯্রােত বয়ে যাচ্ছে। কাজেই এবার তাদের আবার ঘর ছেড়ে পথে নামতে হলো। এবার তারা চলে গেলেন পশ্চিম ইউক্রেনের চেরনিভিটসিতে। এ বিষয়টি তার সন্তানদের ওপর বেশ মানসিক চাপ তৈরি করেছিল।

স্মৃতি দোলা দিয়ে যায় : প্রথমে তারা এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরে অবশ্য একটি আলাদা বাসা ভাড়া নিতে পেরেছেন। রমজানের পুরোনো স্মৃতি যখন তার মনে পড়ছিল, তখন বুঝতে পারছিলেন- কী হারিয়েছেন তিনি।

রাতে কারফিউ জারি : নিয়ারার স্বামী একজন ইমাম হিসেবে কাজ করেন একটি মসজিদে। এটিকে মসজিদ বলা ঠিক হবে না, একটা ঘরকে ঠিকঠাক করা হয়েছে নামাজ পড়ার জন্য। চেরনিভিটসিতে এখন রাতে কারফিউ জারি থাকে। ফলে অনেক সময় তার স্বামীর দেরি হলে তাকে রাতে মসজিদেই থেকে যেতে হয়। তবে এ নতুন অচেনা জায়গাতেও কিছু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে নিয়ারার।

মুসলিমদের প্রতি আবেদন : ‘আমরা এখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্য মানুষদের সঙ্গে ইফতার করি। আমরা পরস্পরকে সাহায্য করি। আমরা ধনী মুসলিমদের প্রতি আবেদনও জানাচ্ছি, যেন তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া লোকজনকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেন’- বললেন নিয়ারা।

হালাল মাংসের সংকট : সেহরিতে হালাল মাংসের সংকট উল্লেখ করে নিয়ারা বলেন, ‘আমরা সচরাচর যে ধরনের খাবার খাই, সে রকম খাবারই রান্না করার চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখানে হালাল মাংস পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে কিছু হালাল মুরগি পাওয়া যায়।’

খাবার রান্নায় সাহায্য : মসজিদে এসে আশ্রয় নিয়েছে যেসব মানুষ, প্রতিদিন তাদের জন্য সাহরি রান্না করতে সাহায্য করেন নিয়ারা। তিনি জানান, ‘তুরস্কের মতো কিছু দেশের মুসলিম ত্রাণ সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় খাদ্য সাহায্য পাঠায়। এর পাশাপাশি স্থানীয় মুসলিমরা কিছু রান্নার হাঁড়িপাতিল, থালা-বাসন দিয়ে সাহায্য করেন।’

মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা : ভিক্টোরিয়া অবশ্য হিমায়িত মাংস এবং মাছ দিয়ে কোনো রকমে রান্না চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক মুসলিম নারী-পুরুষ ইউক্রেনের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে এবং আধা সামরিক বাহিনীতে কাজ করেন। কেউ কেউ সম্প্রতি তৈরি হওয়া সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। ‘আমার অনেক আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু রুশদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। আমরা মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা দিই। লোকজনকে উদ্ধার করতে সাহায্য করি। চাঁদা তুলি। সৈনিকদের জন্য সামরিক সাজ-সরঞ্জাম কিনে দিই।’ বললেন ভিক্টোরিয়া।

মসজিদে ৫ শতাংশ মুসল্লি : কিয়েভের যেটা প্রধান মসজিদ, সেখানে স্বাভাবিক সময়ে যত মানুষ নামাজ পড়তে আসেন, এখন আসছে তার মাত্র ৫ শতাংশ। এ বিষয়টা ভিক্টোরিয়াকে বেশ পীড়া দেয়। ভিক্টোরিয়া মনে করেন, অনেক মুসলিম হয়তো এখনও শহরে আছে। তবে তারা অত্যাবশ্যকীয় নানা সেবা দেওয়ার কাজে বা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাজে ব্যস্ত। সেজন্য তারা হয়তো নামাজ পড়তে মসজিদে আসতে পারছেন না। তবে এ কাজ যে জরুরি, সেটা তিনি বুঝতে পারেন।

জনগণের মূল শক্তি পারস্পরিক ঐক্য : ‘আমাদের লোকজনকে সাহায্য করার জন্য যতটা সম্ভব আমাকে কাজ করে যেতে হবে। দেশপ্রেমিক হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। ইউক্রেনের জনগণের মূল শক্তি হচ্ছে, জনগণের ঐক্য। আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে থাকতে হবে। একে অপরকে সাহায্য করতে হবে। তখনই শুধু আমরা শত্রুকে পরাজিত করতে পারব।’ বললেন ভিক্টোরিয়া।

যুদ্ধটা আসলে আল্লাহর পরীক্ষা : এ সংকট ধর্মের পরীক্ষা উল্লেখ করে ভিক্টোরিয়া বলেন, ‘এ কঠিন দুঃসময়ে ধর্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাকে সাহস জোগায়। আমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি এখানে পাই। এ যুদ্ধটা আসলে আল্লাহর একটা বড় পরীক্ষা।’

বেঁচে থাকার চেষ্টা : নিয়ারা আশা করছেন, তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এ সময় পার করার জন্য তার ধর্মবিশ্বাস তাকে সাহায্য করবে। নিয়ারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহ তাকে এ সংকট উত্তরণে সাহায্য করবেন। ‘আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। শান্তির জন্য প্রার্থনা করছি। শান্তির অপেক্ষায় আছি।’ বললেন নিয়ারা।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত