জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইসলাম

সাঈদ কাদির

প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জীববৈচিত্র্য বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার জীবের একত্র সমাবেশকে বোঝানো হয়। অন্যভাবে বললে, কোনো অঞ্চলের নির্দিষ্ট প্রজাতির মধ্যে জীনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতান্ত্রিক যে তারতম্য বা বিভিন্নতা, তা-ই জীববৈচিত্র্য। জীববিজ্ঞানী ম্যাকেঞ্জি বলেন, ‘বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরের জীবদের ক্ষেত্রে একই প্রজাতির জীবের জীনগত প্রকরণ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্যসমূহকে জীববৈচিত্র্য বলে।’ জীবের এ বৈচিত্র্যময়তা আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত ও নির্ধারিত। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাঁর নিদর্শনাবলির একটি হলো, আসমান ও জমিন এবং এর মাঝে বিস্তৃত জীবজন্তুর সৃষ্টি। নিশ্চয়ই তিনি চাইলেই সবকিছু একত্রিত করতে সক্ষম।’ (সুরা শুরা : ২৯)।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পদক্ষেপ : জীববৈচিত্র্য বা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রাণিজ ও উদ্ভিদজাত সব উপদানকে কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পদ্ধতিতে ব্যবহার করা আবশ্যক। প্রকৃতি ও পরিবেশকে মানবসৃষ্ট সব কৃত্রিম নিয়মনীতি ও অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে জীববৈচিত্র্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। গ্রিন হাউজ এফেক্ট বা পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ভয়াবহ সংকট থেকে বাঁচতে হলে প্রকৃতিকে তার আসল চরিত্র ও নিজস্ব অবস্থায় অক্ষত রাখতে হবে। যদি নিজেরাই জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলি, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতকে যথার্থ ও যথানির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যবহার না করি, তাহলে পরিবেশ আমাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে। পৃথিবী হারিয়ে ফেলবে তার নিজস্ব রূপ, গতিময়তা ও কাঠামো। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জলে-স্থলের সব বিপদ মানুষের হাতের কামাই। যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের কুফল ভোগ করে এবং তা থেকে ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)।

বনাঞ্চল ও বৃক্ষভূমি বৃদ্ধির গুরুত্ব : প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রধানত গাছপালা, তরুলতা, জলবায়ু, জীবজন্তু ও পশুপাখির যথার্থ সংরক্ষণ ও উপযুক্ত ব্যবহারবিধি নিশ্চিত করা দরকার। রাসুল (সা.) পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা সর্বকালে সমানভাবে টেকসই ও প্রযোজ্য। বনাঞ্চল ও বৃক্ষভূমি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) ব্যাপক উৎসাহিত করেছেন। তিনি গাছপালা রোপণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কারও হাতে রোপণ করার কোনো চারা থাকে, এমতাবস্থায় কেয়ামত এসেও যায় এবং রোপণ করার সময় পাওয়া যায়, তাহলে তা রোপণ করা ছাড়া সে যেন দাঁড়িয়ে না থাকে।’ (উমদাতুল কারি : ১২/১৫৪)। অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়া বা ধারাবাহিক পুণ্যের আমল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়-জুলুম না করে কিছু নির্মাণ করল অথবা কোনো চারা রোপণ করল, যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর সৃষ্টি তা থেকে উপকৃত হবে, ততদিন রোপণকারী সওয়াব পেতে থাকবে।’ (উমদাতুল কারি : ১২/১৫৫)।

উদ্ভিদ প্রকৃতির প্রধানতম প্রাণ : উদ্ভিদের মাধ্যমে পরিবেশ, প্রাণী ও আবহাওয়া সপ্রাণ থাকে। উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিটি দেশে মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা জরুরি। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ হলো, প্রত্যেক ভূখণ্ডে পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকা। রাসুল (সা.) একদিকে বনভূমি বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন, অন্যদিকে গাছপালা কাটা ও বন উজাড় করার ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রেও তোমরা কোনো খেজুরগাছ বা অন্যান্য উদ্ভিদ কেটে ফেলো না।’ (এরশাদুল ফকিহ : ২/৩২০)।

পানির অপচয় রোধ ও পানিতে বর্জ্যত্যাগ পরিহার : জলবায়ু পরিবর্তন, আবহাওয়ার চরম বৈরিতা ও জলদূষণ দূরীকরণে রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনা মেনে চললে সহজে ও কার্যকরীভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। কারণ পানির অপচয় রোধ ও পানিতে সবধরনের আবর্জনা ও বর্জ্যত্যাগ পরিহার করলে আবহাওয়াজনিত দূষণ থেকে বেঁচে থাকা সহজ। আর পানির অপচয় রোধে রাসুল (সা.) খুব যত্নবান ছিলেন। একবার সাদ (রা.) অজুতে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছিলেন; রাসুল (সা.) তাকে বললেন, ‘সাদ! পানির অপচয় করছ কেনো?’ তিনি বললেন, ‘অজু করার ক্ষেত্রেও কী অপচয় হয়?’ রাসুল বললেন, ‘অবশ্যই। এমনকি তুমি যদি বহমান নদী বা সাগরে বসেও অজু করো, তাহলেও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার অপচয় হিসেবে গণ্য হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১৯)।

যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ জলবায়ু দূষণের কারণ : যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ জলবায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। সেজন্য রাসুল (সা.) ছায়াদার গাছের নিচে, মানুষের চলাচলের রাস্তায় ও স্থির পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘তোমরা দুই অভিশপ্ত লোক থেকে বেঁচে থাকো।’ সাহাবিরা বললেন, ‘তারা কে কে?’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি লোকদের হাঁটাচলার রাস্তায় মলমূত্র ত্যাগ করে এবং যে মানুষের ছায়া গ্রহণস্থলে পায়খানা-প্র¯্রাব করে।’ (মুসলিম : ১/১৮৮)। আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন স্থির পানিতে প্রস্রাব না করে।’ (মুসলিম : ১/৭৩)।

পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মুক্তির সোপান : ঘরবাড়ি, আঙিনা, রাস্তাঘাট ও শহর-বন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়মুক্ত হবে। পরিচ্ছন্নতার অভাবেই পৃথিবীর অনেক দেশ, অসংখ্য শহর ও নানা ভূখণ্ড ধীরে ধীরে বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে। পরিণত হচ্ছে জনজীবন বিপণ্ণকারী হিসেবে।

এ ব্যাপারেও রাসুল (সা.) যথার্থ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের আঙিনা পরিষ্কার রাখো, ইহুদিরা তাদের বসবাসস্থলের চারপাশ অপরিচ্ছন্ন রাখে।’ (তাবারানি : ২/১১)।

পশুপাখি ও জীবজন্তুর মাধ্যমে পরিবেশের বিপর্যয় রোধ : পশুপাখি ও জীবজন্তু দ্বারা ব্যাপকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় রোধ হয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য জীবজন্তু সৃষ্টি করে পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক রেখেছেন। মানুষ যদি অহেতুক প্রাণীহত্যার সংস্কৃতি চালু করে, তা হবে পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ। এজন্য রাসুল (সা.) কোনো প্রাণী অযথা মেরে ফেলা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি চড়ুই পাখি বা তার চেয়ে ছোট কোনো প্রাণীকেও অকারণে হত্যা করে, কেয়ামতের দিন তাকে জবাবদিহিতা করতে হবে।’ (মিরকাত : ২৬৫৮)।