ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিচ্ছন্নতা মোমিনের বৈশিষ্ট্য

মিজান ইবনে মোবারক
পরিচ্ছন্নতা মোমিনের বৈশিষ্ট্য

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ এক জীবন বিধান। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ইসলামের আদর্শ, বিধিবিধান। এতে যেমন রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মনীতি, তেমনি সমাজ ও ব্যক্তি জীবন পরিচালনার যাবতীয় পদ্ধতি। আল্লাহর দেয়া বিধিবিধানের আনুগত্য মোমিন জীবনের সফলতা। আনুগত্যের জন্য রয়েছে কিছু শর্ত, কিছু নিয়মনীতি। পবিত্রতা অর্জন করা যার অন্যতম। পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রতিটি মোমিনের গুণ। ইসলাম যেমন সুন্দর, তেমন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। অপরিচ্ছন্নতার কোনো স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দেয়; বরং মৃত্যুর পরও পরিচ্ছন্ন করে কবরে রাখার হুকুম দেয়। নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় রোকন। এর জন্য শরীর, কাপড়, জায়গা পবিত্র হওয়া শর্ত। অজু থাকা সত্ত্বেও নামাজের সময় অজু করা, অজু ভাঙলে অজু করা, শরীর থেকে রক্ত বেরুলে তা পরিষ্কার করে নামাজ পড়ার বিধান রয়েছে। প্রত্যেক অঙ্গকে তিনবার ধৌত করা, অজুর সময় মেসওয়াক করার উৎসাহ, কুলি করার সময় গড়গড়ার সঙ্গে কুলি করা; নাক ভালোভাবে পরিষ্কার করা, নাপাক থাকলে গোসল করার হুকুম, গোসলে সারা শরীরে ভালোভাবে পানি পৌঁছানোর হুকুম; নখ কাটা, গোফ ছাঁটা, অবাঞ্ছিত পশম কাটা, ইস্তেঞ্জার পর ভালোভাবে পরিষ্কার হওয়া, ঘুম থেকে উঠে পানির পাত্রে হাত দেয়ার আগে হাত ধোয়ার বিধান- এ সবই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, ইসলামে পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অনেক বেশি।

মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য : আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দশটি কাজ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত- ১. গোঁফ কাটা, ২. দাঁড়ি লম্বা রাখা, ৩. মেসওয়াক করা, ৪. নাকে পানি দেয়া, ৫. নখ কাটা, ৬. আঙুলের গ্রন্থিগুলো ধোয়া, ৮. বগলের লোম উপড়ে ফেলা ও নাভির নিম্নাংশের চুল পরিষ্কার করা, ৯. পানি দ্বারা শৌচকর্ম সম্পাদন করা।’ (বর্ণনাকারী) জাকারিয়া (রহ.) বলেন, মুসআব (রহ.) বলেছেন, ‘আমি দশম কাজটি ভুলে গিয়েছি। তবে সম্ভবত সেটা হবে- কুলি করা।’ (তিরমিজি : ২৭৫৭)। নুআইম মুজমির (রহ.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে; তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর সঙ্গে মসজিদের ছাদে উঠলাম। অতঃপর তিনি অজু করে বললেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কেয়ামতের দিন আমার উম্মতকে এমন অবস্থায় আহ্বান করা হবে যে, অজুর প্রভাবে তাদের হাত-পা ও মুখমণ্ডল উজ্জ্বল থাকবে। তাই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে নিতে পারে, সে যেন তা করে।’ (বোখারি : ১৩৬)।

পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ : আবু মালেক আশআরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ (মুসলিম : ২২৩)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘নামাজ বেহেশতের চাবি, আর অজু নামাজের চাবি।’ (তিরমিজি : ৪)। সেজন্যই ইসলামে সতর্কতাস্বরূপ ঘুম থেকে উঠে আগে হাত ধুয়ে তারপর পাত্রে হাত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে জাগে, তখন সে যেন হাত তিনবার না ধুয়ে পাত্রে হাত না রাখে। কেননা, তোমাদের কেউ জানে না (ঘুমন্ত অবস্থায়) তার হাত কোথায় ছিল অথবা তার হাত কোথায় কোথায় ঘুরেছিল!’ (সুনানে আবি দাউদ : ১০৫)।

মুখ পরিষ্কার রাখার গুরুত্ব : মানুষ সারা দিন বিভিন্ন প্রয়োজনে কথাবার্তা বলে। মুখ থেকে দুর্গন্ধ এলে তা অন্যের বিরক্তি এবং কষ্টের কারণ হয়। এতে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। মেসওয়াক দাঁত পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে খুব ভালো। মেসওয়াকে রয়েছে বহু উপকারিতা। তাই হাদিসে মেসওয়াক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করার কথা খুব জোরালোভাবে বলা হয়েছে। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) দিনে বা রাতে যখনই ঘুম থেকে জাগতেন, তখন অজু করার আগে মেসওয়াক করতেন।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ৩৮৩)। আবু উমামা বাহেলি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মেসওয়াক কর। কেননা, মেসওয়াক মুখের পবিত্রতা এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৯)। যায়েদ ইবনে খালিদ আল জুহানি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যদি আমার উম্মতের ওপর কষ্টকর না হতো, তাহলে আমি অবশ্যই তাদেরকে প্রত্যেক সালাতের আগে মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৭)।

অজুর প্রতি বিশেষ তাগিদ : পবিত্রতা ছাড়া নামাজ আদায় হয় না। পবিত্রতা নামাজের শর্ত। অজুর দ্বারা পবিত্রতা অর্জন হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা যখন নামাজের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন নিজেদের মুখমণ্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে, মাথা মাসেহ করবে এবং পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত করবে; যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। তোমরা যদি পীড়িত হও কিংবা পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে নেবে।’ (সুরা মায়িদা : ৬)।

গোসলের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত (ব্যক্তি)! ওঠ, মানুষকে সতর্ক কর। নিজ প্রতিপালকের মহিমা ঘোষণা কর। নিজ পোশাক পবিত্র রাখ এবং (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ১-৫)। গোসল দ্বারা শরীর সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। তাই হাদিসে অন্তত সপ্তাহে একবার হলেও ভালোভাবে গোসল করতে বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অবশ্য কর্তব্য হলো, (অন্তত) প্রতি সাতদিনে একদিন সে গোসল করবে, তার মাথা ও শরীর ধৌত করবে।’ (বোখারি : ৮৯৭)।

সাধ্যমতো পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান : সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে ভালো পোশাক পরিধান করেন না। এটা অনুচিত; বরং নিজের মধ্যে আল্লাহতায়ালার দেয়া নেয়ামত ও অনুগ্রহ প্রকাশ করা চাই। সাহাবি মালেক ইবনে নাজলা (রা.)-এর ঘটনা। তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি মসজিদে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বসেছিলাম। তিনি দেখলেন, আমার গায়ে ছেঁড়াফাটা কাপড়। তখন জানতে চাইলেন, ‘তোমার কি অর্থসম্পদ আছে?’ বললাম, ‘সব রকম সম্পদই আছে।’ বললেন, ‘আল্লাহ যখন তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন, তা-ই এর চিহ্ন; যেন তোমার ওপর প্রকাশ পায়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৬৩)।

ঘুমানোর সময় পবিত্রতা অর্জন : সারা দিনের ক্লান্তি শেষে রাতে ঘুমানোর সময় পবিত্রতা অর্জন করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ঘুমানোর কথা হাদিসে এসেছে। এতে দৈহিক এবং মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি রয়েছে পরকালীন অনেক কল্যাণ। মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান রাতে পবিত্র অবস্থায় জিকির করতে করতে শোয়, এরপর ঘুম ভেঙে গেলে সে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে, তখন আল্লাহতায়ালা তাকে তা দান করেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯৫৮)।

বারা ইবনে আজেব (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তুমি শোয়ার বিছানায় যেতে চাও, তখন সালাতের অজুর মতো অজু করবে। এরপর ডান পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়বে।’ (বোখারি : ৬৩১১)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের কোনো ব্যক্তি শয্যা গ্রহণ করতে যায়, তখন সে যেন তার বিছানা ঝেড়ে নেয়। কারণ, সে জানে না যে, বিছানার ওপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কি না।’ (বোখারি : ৬৩২০)।

পরিচ্ছন্নতার প্রতি অবহেলার শাস্তি : অনেকেই প্রস্রাবের পর ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না। সে অবস্থায়ই নামাজ আদায় করে থাকে। কিন্তু এতে তার নামাজ হয় না; বরং অপবিত্র অবস্থায় নামাজ আদায়ের কারণে কবরে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পেশাব থেকে অসতর্কতার কারণে বেশিরভাগ কবরে আজাব হয়ে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৪৮)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত